মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥ টঙ্গীর তুরাগ তীরে তাবলীগ জামাতের এবারের বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে। সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে বাস-ট্রাক, কার-পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে দলে দলে মুসল্লিরা ইতোমধ্যে টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমাস্থলে আসছেন। তারা কাঁধে-পিঠে প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে এজতেমাস্থলে এসে নিজ জেলার খিত্তায় অবস্থান নিচ্ছেন। টঙ্গীর এজতেমাস্থল এখন মুসল্লিদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। আজ প্রথম দিন শুক্রবার বাদ ফজর আনুষ্ঠানিক আমবয়ানের মাধ্যমে তাবলীগের বুজুর্গ মুরুব্বীরা এর সূচনা করেন। তবে বৃহস্পতিবারই বিশ্ব এজতেমার বিশাল ময়দানে লাখো মুসল্লি জমায়েত হওয়ায় বাদ মাগরিব থেকেই মুসল্লিদের মাঝে হেদায়েতী বয়ান শুরু হয়েছে।
এবার প্রথমবারের মতো চার ভাগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব এজতেমা। দেশের মোট ৩২টি জেলা নিয়ে এ বছর এজতেমার দুই পর্ব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগামী বছরে (২০১৭ সালে) বিশ্ব এজতেমার দু’পর্বে বাকি ৩২ জেলার মুসল্লিরা অংশ নিবে। এ বছরের প্রথম পর্বে অংশ নেবে ঢাকার একাংশসহ ১৭টি জেলার তাবলীগ অনুসারীরা। দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেবে ১৫টি জেলাসহ ঢাকার বাকি অংশের তাবলীগ অনুসারীরা। তবে বিদেশী মুসল্লিরা প্রতিবছর বিশ্ব এজতেমায় অংশ নিতে পারবে। মুসল্লিদের স্থান সংকূলান না হওয়ায় এবং নিরাপত্তার কথা ভেবে ২০১১ সাল থেকে দু’পর্বের এজতেমা শুরুর পর এবার আবারও এ পরিবর্তন আনা হলো। বিশ্ব এজতেমার শীর্ষ পর্যায়ের মুরুব্বীরা এজতেমার এ তারিখ নির্ধারণ করেছেন।
এবারের (২০১৬ সালের) বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব দেশের ৩২টি জেলার মুসল্লিদের নিয়ে টঙ্গী তুরাগ তীরে দু’ধাপে শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে এবং আগামী রবিবার (১০ জানুয়ারি) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এজতেমার প্রথমপর্ব শেষ হবে। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে ১৫ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেবে ঢাকার বাকি অংশসহ ১৬টি জেলার তাবলীগ অনুসারী। ১৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে দু’পর্বের এবারের বিশ্ব এজতেমা।
এবারের বিশ্ব এজতেমার আগের দিন বৃহস্পতিবার জামায়াতে ইসলামীর ডাকা বৃহস্পতিবারের হরতাল এজতেমার উদ্দেশে আসতে থাকা মুসল্লিদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পথে দুর্ভোগ থাকা সত্ত্বেও সকল বাধা উপেক্ষা করে তবলীগ অনুসারী মুসল্লিরা গাড়িতে চড়ে ও হেঁটে বিশ্ব এজতেমা ময়দানে আসছেন দলে দলে। তবে এমন কর্মসূচীর কারণে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এজতেমায় আসা তাবলীগ মুসল্লিরা। সাধারণ মানুষও এমন কর্মসূচীর তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন। তাদের মতে, এ বিশ্ব এজতেমায় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ যোগ দিয়ে থাকেন। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধের মধ্য দিয়েও নানা দূর্ভোগ শিকার করে গত বছরের বিশ্ব এজতেমায় দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি অংশ নিয়েছেন।
তাবলীগ জামাতের উদ্যোগে প্রতিবছর এ বিশ্ব এজতেমা অনুষ্ঠিত হয় টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে। প্রায় ১৬০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এজতেমা মাঠে বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম দেশ থেকেই তবলীগ জামাতের অনুসারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেন। তারা এখানে তবলীগ জামাতের শীর্ষ আলেমদের বয়ান শুনেন এবং ইসলামের দাওয়াতী কাজ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেয়ার জন্য জামাতবদ্ধ হন। এখান থেকেই দ্বীনের দাওয়াতী কাজে বেরিয়ে যান। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের তবলীগ অনুসারীরা মিলিত হন এজতেমায়।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ও কল-কারখানার শ্রমিক-মালিকসহ বিভিন্ন পেশার মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা বিশ্ব এজতেমার মাঠে প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করেছেন। এজতেমা ময়দানে জেলাওয়ারি মুসল্লিদের স্থানও (খিত্তা) নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মুসল্লিদের তুরাগ নদ পারাপারের জন্য সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা তুরাগ নদের ৯টি স্থানে ভাসমান সেতু নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করেছে।
বৃহস্পতিবার দেখা গেছে, এজতেমা মাঠের পশ্চিম পাশের মাঝামাঝি এলাকায় তুরাগ তীরে নামাজ পড়ার মিনার ও বয়ান মঞ্চ এবং পশ্চিম-উত্তর কোণায় দোয়া মঞ্চ, মাঠে তাশকিলের কামরা, মোকাব্বির মঞ্চ, জুড়নেওয়ালে জামাত কক্ষ নির্মাণসহ বিশেষ ছাতা মাইক স্থাপনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। গোসলের হাউস ও টয়লেট স্থাপন ও সংস্কারের কাজও শেষ হয়ে গেছে।
বিদেশী মুসল্লিদের জন্য মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোণে গড়ে তোলা হয়েছে বিদেশী মেহমানদের (মুসল্লি) আবাসন ব্যবস্থা। সেখানে বিদ্যুত, টেলিফোন, গ্যাস সংযোগসহ রয়েছে আধুনিক সুবিধাদি। বিদেশী নিবাসের রন্ধনশালায় রয়েছে তাদের আপ্যায়নের নানা আয়োজন। বিদেশী মেহমান খানার জিম্মাদার জানান, ইতোমধ্যেই বহু বিদেশী মেহমান এজতেমা ময়দানে এসে পৌঁছেছেন। অনেকে পথে রয়েছেন। মঙ্গলবার থেকে বিদেশী মেহমানরা আসতে শুরু করেছেন। আখেরি মোনাজাতের দিন পর্যন্ত তাদের এ আগমন অব্যাহত থাকবে। এখানে ইংলিশ, আরব, অনারবদের জন্য আলাদা আলাদা তাঁবু ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিন তাদের পছন্দমাফিক খাবারও সরবরাহ করা হচ্ছে। বিশ্ব এজতেমা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা বাণী দিয়েছেন।
বিদেশী মুসল্লিদের জন্য এজতেমার মূল ছয় দিনের প্রতিদিন এখানে প্রায় ৪ টন গরু, ৫ টনের মতো মুরগি ও ১ টনের মতো খাসির মাংস, প্রায় ৫ টন মাছ ও ৪ টন সবজির প্রয়োজন হয়। এছাড়া প্রতিদিন তুন্দুর রুটি লাগে ২০ হাজারের মতো। এজতেমার মাঠের প্রস্তুতির কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা তবলীগের শীর্ষ মুরুব্বী গিয়াস উদ্দিন জানান, সব কাজ করা হয় মোশায়ারার (পরামর্শ) মাধ্যমে। এ বছর বাইরের প্রায় ৩০Ñ৪০টি দেশ থেকে ৩০ হাজারেরও বেশি মুসল্লি এজতেমায় যোগ দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রথম পর্বে মুসল্লিরা খিত্তা ওয়ারি যেভাবে অবস্থান নেবেন ॥ এবারের বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বে ২৭টি খিত্তায় ঢাকার একাংশসহ ১৭ জেলার মুসল্লিদের জন্য ময়দানে জেলাওয়ারি মুসুল্লিদের স্থান (খিত্তা) নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মুসল্লিরা জেলাওয়ারি এসব খিত্তায় অবস্থান নেবেন।
মুসল্লিরা জেলাওয়ারী যে সকল খিত্তায় অংশ নিবেন সেগুলো হলোÑ ঢাকা ১ থেকে ৬নং খিত্তায়, শেরপুর ৭নং খিত্তায়, নারায়ণগঞ্জ ৮ ও ১১নং খিত্তায়, নীলফামারী ৯নং খিত্তায়, সিরাজগঞ্জ ১০নং খিত্তায়, নাটোর ১২নং খিত্তায়, গাইবান্ধা ১৩নং খিত্তায়, লক্ষীপুর ১৪ ও ১৫নং খিত্তায়, সিলেট ১৬ ও ১৭নং খিত্তায়, চট্টগ্রাম ১৮ ও ১৯নং খিত্তায়, নড়াইল ২০নং খিত্তায়, মাদারীপুর ২১নং খিত্তায়, ভোলা ২২ ও ২৩নং খিত্তায়, মাগুড়া ২৪নং খিত্তায়, পটুয়াখালী ২৫নং খিত্তায়, ঝালকাঠি ২৬নং খিত্তায় এবং পঞ্চগড় ২৭নং খিত্তায়।
দ্বিতীয় পর্বে যেভাবে অবস্থান নেবেন ॥ দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেবে ১৫টি জেলাসহ ঢাকা জেলার বাকি অংশের তাবলীগ অনুসারী মুসল্লিরা। ওইসব জেলা ও খিত্তাগুলো হলোÑ ঝিনাইদহ ৮নং খিত্তায়, জামালপুর ৯ ও ১১নং খিত্তায়, ফরিদপুর ১০নং খিত্তায়, নেত্রকোনা ১২ ও ১৩নং খিত্তায়, নরসিংদী ১৪ ও ১৫নং খিত্তায়, কুমিল্লা ১৬ ও ১৮নং খিত্তায়, কুড়িগ্রাম ১৭নং খিত্তায়, রাজশাহী ১৯ ও ২০নং খিত্তায়, ফেনী ২১নং খিত্তায়, ঠাকুরগাঁও ২২নং খিত্তায়, সুনামগঞ্জ ২৩নং খিত্তায়, বগুড়া ২৪ ও ২৫নং খিত্তায়, খুলনা ২৬ ও ২৭নং খিত্তায়, চুয়াডাঙ্গা ২৮নং খিত্তায় এবং পিরোজপুর ২৯নং খিত্তায়।
তুরাগ নদীতে ভাসমান সেতু স্থাপন ॥ মুসল্লিদের তুরাগ নদী পারাপারের ৯টি ভাসমান সেতু স্থাপন করা হয়েছে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের তত্ত্বাবধানে। ইতোমধ্যে সেতুগুলো মুসল্লিদের চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা ॥ গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, এজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের নিরাপত্তায় সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আজ থেকে ৫ স্তরে ১২ হাজার পুলিশ সদস্য ২৪ ঘণ্টা মুসল্লিদের নিরাপত্তা দানে নিয়োজিত থাকবে। এছাড়াও সাদা পোশাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পর্যাপ্ত সদস্য নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
পানি, বিদ্যুত, চিকিৎসা সেবা ॥ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের টঙ্গী অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, এজতেমা মাঠে স্থাপিত উৎপাদন নলকূপের মাধ্যমে প্রতিদিন তিন কোটি লিটারেরও বেশি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের সকল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ওজু-গোসলের হাউস ও টয়লেটসহ প্রয়োজনী স্থানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়াও পাকা দালানে প্রায় ৬ হাজারের মতো টয়লেট ইউনিট রয়েছে। এদের মধ্যে নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত ওজু-গোসলখানা এবং টয়লেটগুলো ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে।
ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প উদ্বোধন ॥ বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে মন্নু টেক্সটাইল মিলের মাঠে হামদর্দ ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। হামদর্দ বোর্ড অব স্ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম আর খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ওয়াকফ প্রশাসন ফয়েজ আহাম্মেদ ভূইয়া, হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চীফ মোতয়ালী ড. হাকিম মোঃ ইউসুফ হারুন ভূঁইয়া প্রমুখ।
বিশেষ বাস ও ট্রেন সার্ভিস ॥ মুসল্লিদের সুবিধার্থে এজতেমার শুরুর আগের দিন থেকে থেকে বিআরটিসি ২২৮টি স্পেশাল বাস সার্ভিস ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। বিআরটিসির একটি সূত্র জানায়, ৭ জানুয়ারি থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত চলাচলকারী স্পেশাল বাসের মধ্যে ৩টি বাস বিদেশী মুসল্লিদের জন্য রিজার্ভ থাকবে।
এজতেমাগামী বাস খাদে, নিহত ১ ॥ স্টাফ রিপোর্টার ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সরাইলে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে ১ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে ছেড়ে আসা এনা পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটি ঢাকা যাবার পথে সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর এলাকার বৈশামুড়া ব্রিজের পূর্বদিকে একটি বালুবাহী ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মুফতি মাসুম (৩৮) মারা যান। তিনি বিয়ানীবাজার এলাকার দেওগ্রামের বাসিন্দা।