ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক রায়হান আহমেদ তপাদার

ব্রিটিশ ভিসা বিড়ম্বনায় বাংলাদেশ!

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

ব্রিটিশ ভিসা বিড়ম্বনায় বাংলাদেশ!

১৮০৯ সালে প্রথম বাঙালী তথা সিলেটের অধিবাসী সৈয়দ আলী যুক্তরাজ্যে পদার্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর অভিবাসনের যে গোড়াপত্তন হয়েছিল, তা এখন সাত লাখ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এ দেশের মানুষ ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে ভিসা লাভ করে আসছে। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ব্রিটিশ ভিসা প্রসেসিং কার্যক্রম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী থেকে হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং জনগণের জন্য নিতান্তই অবমাননাকর এবং অসম্মানজনক পদক্ষেপ। বাংলাদেশীদের জন্য ব্রিটেনের ভিসা প্রক্রিয়া দিল্লীতে স্থানান্তরকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি চরম অবমাননাকর বলে আমরা মনে করি। শুধু আমি কেন, এর সঙ্গে সবাই একমত পোষণ করবেন বলে আমার বিশ্বাস। এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ব্রিটিশ হোম এ্যাফেয়ার্স সিলেট কমিটির চেয়ার কিথ ভাজ এমপি। তার দাবি- দিল্লী নয়, ঢাকাতেই হতে হবে বাংলাদেশীদের জন্য ব্রিটিশ ভিসার সকল প্রসেসিং। ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে এই সিদ্ধান্তের কঠোর প্রতিবাদ জানানোর পর এবার এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশীদের নিয়ে ক্যামপেইন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ। কিন্তু অজানা কোন কারণে স্থবির হয়ে গেল এসব সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে রাজনীতিবিদদের উল্লেখযোগ্য কোন বক্তব্য বা পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এমনকি সরকারের কাছ থেকেও এ বিষয়ে চোখে পড়ার মতো কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অথচ ব্রিটেন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা বহন করে। তাই এ বিষয়ে দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্রে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি। এদিকে ব্রিটেনে লেবার সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে কিথ ভাজ এমপি সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনের আরও একটি ভিসা প্রসেসিং সেন্টার চালু করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তিনি সফলও হয়েছিলেন। তিনি সে সময় সিলেট সফরে গিয়ে ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে সহযোগিতা পেতে ইমিগ্রেশন এ্যাডভাইজরি সার্ভিস নামের একটি প্রতিষ্ঠানও উদ্বোধন করেন। কিন্তু কেন জানি বাঙালীদের কপালে তা সইল না, চলে গেল দিল্লীতে। এত প্রয়োজনীয় ও দেশের মঙ্গলের সঙ্গে জড়িত এমন দরকারি একটি বিষয় হাতছাড়া হয়ে গেল। ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের সব ধরনের ভিসা প্রসেসিং বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। এমনকি ১ অক্টোবর থেকে জমা পড়া ভিসা সংক্রান্ত আবেদনের কোন সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশন। তখনও আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদদের টনক নড়েনি। এমনকি এখনও কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সিলেটে ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এ নিয়ে যুক্তরাজ্য ব্রিটিশ বাংলাদেশীরাও সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। ব্রিটেনের কারিশিল্পের সঙ্গে যুক্ত নেতৃত্ববৃন্দও এ নিয়ে লবিং করে যাচ্ছেন। এমনকি তাদের উদ্যোগে স্বাক্ষর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের এ উদ্যোগকে দেশবাসী অভিনন্দন জানিয়েছেন। এমনকি তাঁদের সঙ্গে কিথ ভাজ এমপিও পার্লামেন্টারি সিলেক্ট কমিটির সভায় হোম সেক্রেটারি থেরেসা মে’র কাছে সরকারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, ব্রিটেনে এশিয়ান কমিউনিটির মধ্যে বাংলাদেশীরা বহির্বিশ্বে একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে এবং ব্রিটেনেও তাঁদের উপস্থিতি সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ বিষয়ে আমাদের সরকার এবং রাজনীতিবিদদের উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ বাংলাদেশের মানুষ দেখেনি। সিদ্ধান্তটি ভারতমুখী হওয়ায় ব্রিটিশ ভিসা পেতে বাংলাদেশীরা সীমাহীন ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। ব্রিটিশ ভিসা দরখাস্তকারী অনেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন কিংবা সময়মতো ভিসা পাননি, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার্থে ব্রিটেনে আসতে চান এমন শিক্ষার্থীরাও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন, যা আমাদের শিক্ষানীতিতেও আঘাত হানছে। ভিআইপি থেকে শুরু করে দেশের মন্ত্রী-এমপি এবং খ্যাতিমান সাংবাদিক, লেখক, কবি, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং চিত্রজগতের তারকারাও এই বিড়ম্বনার শিকার। এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ সালে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে ৩০ হাজার ৪১৮ জন আবেদন করেন। এর মধ্যে সাধারণ ক্যাটাগরিতে ১৫ হাজার ২৯০ জনকে, সাত হাজার ৬২৯ জনকে পারিবারিক ক্যাটাগরিতে এবং দুই হাজার ৬২৮ জনকে শিক্ষার্থী ক্যাটাগরিতে ভিসা প্রদান করা হয়েছিল। ওই বছর মোট ভিসা প্রদান করা হয়েছিল ২৩ হাজার ১৯৭ জনকে। অর্থাৎ ওই বছর ভিসা আবেদনকারীর ৭১ শতাংশ ভিসা পেয়েছিলেন। ২০১৪ সালে প্রায় ৩২ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে প্রায় ২১ হাজার ভিসা পেয়েছিলেন। অর্থাৎ ওই বছর ভিসা পেয়েছিলেন ৬৭ শতাংশ, যা বিগত বছরের তুলনায় মাত্র ৪ শতাংশ কম। কিন্তু ওই বছরের ১ অক্টোবর থেকে ভিসা সেন্টার ভারতে স্থানান্তর করা হয়, যার ফলে ২০১৫ সালে প্রায় ১৯ হাজার ১০০ আবেদনকারীর মধ্যে নয় হাজার আবেদনকারী ভিসা পেয়েছেন, যার শতকরা হিসাবে মাত্র ১৭ ভাগ। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নাতনী এখানকার এমপি। আরও দু’জন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপি রয়েছেন। তারা বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। এই সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করা উচিত বলে আমরা মনে করি। তাছাড়া ব্রিটেনে বাংলাদেশীরা যেভাবে সকল ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করেছেন এবং করে যাচ্ছেন তার যথাযথ মূল্যায়ন পাওয়ার দাবি রাখে ব্রিটিশ সরকারের কাছে। বাংলাদেশের ব্রিটিশ হাইকমিশন স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে প্রায় পাঁচ শ’ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তথ্য চলে যাচ্ছে ভারতে। এতে করে বাংলাদেশ একদিন বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশের গর্ব তিন এমপি এ বিষয়ে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করবেন। এ বিষয়ে আমাদের দায়িত্ব হবে বাঙালী তিন এমপি কন্যাকে সচেতন করা। এক জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটিশ হাইকমিশন স্থানান্তরে বাংলাদেশীদের ব্রিটিশ ভিসাপ্রাপ্তির সংখ্যা ২০১৩ সালে শতকরা ৭১ শতাংশ, ২০১৪ সালে শতকরা ৬৭ এবং ২০১৫ সালে মাত্র শতকরা ১৭ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় আমরা কোথায় যাচ্ছি? দেশ উন্নয়নের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়নে বরং একটা অংশ ইউকে প্রবাসীদের কাছ থেকে আসে এটা নিশ্চিত বলা যায়। তবে কেন সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর এত উদাসীনতা তা আমার বোধগম্য নয়। এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। ব্রিটেন প্রবাসী সকল রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তিন ব্রিটিশ এমপি, কারিশিল্পে সংশ্লিষ্ট নেতৃত্ব, সাংবাদিক, শিক্ষক/শিক্ষিকা, বার কাউন্সিলর ও কমিশনার, সকল প্রকার কর্মকর্তা-কর্মচারী, সকল প্রকার মিডিয়া, আলেম-ওলামা, ব্রিটেনের সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী নেতৃত্ব, সকল এলাকার ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন, এডুকেশন ট্রাস্ট এবং সকল ধরনের সংগঠন ও সাধারণ নাগরিকদের সংগঠিত করে নাম-ঠিকানাসহ স্বাক্ষর কালেকশন পূর্বক দেশে ও বিদেশে লিখিত প্রতিবাদ করতে পারলে অবশ্যই ব্রিটিশ হাইকমিশন বাংলাদেশে ফেরত আসবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে আমার চেয়ে অনেক জ্ঞানী-গুণীজন আছেন, এ বিষয়ে আপনাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। লেখক : লন্ডন প্রবাসী
×