ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সন্তোষ প্রকাশ করে গণজাগরণ মঞ্চ, সেক্টর্স কমান্ডার্স ফোরামসহ রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিবৃতি ও কর্মসূচী

কলঙ্কমুক্তির পথে আরও এক ধাপ এগোল দেশ

প্রকাশিত: ০৫:১২, ৭ জানুয়ারি ২০১৬

কলঙ্কমুক্তির পথে আরও এক ধাপ এগোল দেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কুখ্যাত দোসর ও বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম রূপকার মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় আপীল বিভাগে বহাল থাকায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন, গণজাগরণ মঞ্চ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন। পৃথক পৃথক কর্মসূচী ও বিবৃতিতে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের সঙ্গে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি তুলেছেন। তারা মনে করেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্তির পথে আরও একধাপ অগ্রসর হবে। পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশে পাকিস্তানের দূতাবাস বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন সেক্টরের নেতৃবৃন্দ। সেই সঙ্গে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনাসহ একাত্তরের সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রাখার গণশপথ নিয়েছেন হাজারও জনতা। গণঅবস্থানে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার ॥ কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সকাল থেকে ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার’ শীর্ষক অবস্থান কর্মসূচীর আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ কর্মসূচী পালন করা হয়। রাস্তা আটকে দুটি ট্রাক দিয়ে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে দুপুর পর্যন্ত এ অবস্থান চলে। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। সরকারের মন্ত্রী, সাংবাদিক, অভিনেত্রী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের সেনা সদস্যদের বিচার ও দেশীয় রাজাকারদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার গণশপথে অংশ নেন হাজারও মানুষ। কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন খালেদা জিয়া স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে যেসব বাণী দিয়েছেন সেখানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ উল্লেখ করতেন। অথচ এখন তিনি ভিন্ন কথা বলছেন। তার বক্তব্য স্ববিরোধী। খালেদা জিয়া পাকিস্তানীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে নিহত শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার পক্ষে এসব কথা মানায়। সরকারের সঙ্গে খালেদা জিয়া আলোচনায় বসার যে প্রস্তাব করেছেন তা প্রত্যাখ্যান করে মন্ত্রী বলেন, শহীদের সংখ্যা নিয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার ও জাতির কাছে ক্ষমা না চাইলে কোন আলোচনা হবে না। অন্যদিকে একই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচারের আহ্বায়ক শাজাহান খান কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রত্যাহার করতে বলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এটা আমাদের জন্য অপমান। তার কোন দোষ নেই।’ শাজাহান খান বলেন, যতই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হচ্ছে পাকিস্তানের গা-জ্বালা বাড়ছে। এ জন্য তারা একেকটা ফাঁসির পর একেক ধরনের মন্তব্য করছে। আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন পাকিস্তানের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একজন কর্মকর্তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলে আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জঙ্গীবাদে মদদ দেয়ার জন্য তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। সে কারণে আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তার প্রতি এ ধরনের অপমানজনক ও ন্যক্কারজনক আচরণ করেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী সেনাসদস্যের বিচারের দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আজ বৃহস্পতিবার থেকে গণসংযোগ শুরু করবে। আর ১৭ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করবে সংগঠনটি। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনাসহ একাত্তরের সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রাখার জন্য অবস্থান কর্মসূচীতে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে শপথ পাঠ করান শাজাহান খান। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান দূতাবাস বন্ধের দাবি ইমরানের ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ একাত্তরে গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রাখার প্রতিবাদে ডাকা জামায়াতের হরতাল প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। নিজামীর আপীলের রায়ের পর হরতাল ডাকে জামায়াত। এর পরপরই মঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার ধ্বংসাত্মক এ কর্মসূচী প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বুধবার সকাল আটটা থেকে প্রজন্ম চত্বরে অবস্থান নেয় মঞ্চের নেতাকর্মীরা। রায়ের পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে এক প্রতিক্রিয়ায় ইমরান বলেন, সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল থাকাই প্রমাণ করে, যেসব রাজনীতিক তাকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, তাদের গালে চপেটাঘাত দেয়া হয়েছে। ইমরান বলেন, নিজামী শুধু যুদ্ধাপরাধীই নন, তিনি এদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন। দেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করেছেন। সে কারণে নিজামীর অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এ রায়ের মাধ্যমে প্রমাণ হলো নিজামী বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন তার অবসান হলো। এ রায়ের মাধ্যমে দেশের মানুষ সন্তুষ্টি ও স্বস্তি পেয়েছে বলেও মনে করেন ইমরান এইচ সরকার। পাকিস্তানের ১৯৫ যুদ্ধাপাধীর বিচারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তান আমাদের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করার হুমকি দিয়ে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তাই আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের সব কূটনীতিককে বহিষ্কার ও বাংলাদেশে পাকিস্তানের দূতাবাস বন্ধের দাবি জানান তিনি। দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে ইমরান এইচ সরকার বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলো। অবিলম্বে তা কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানান তিনি। এদিকে আপীল বিভাগের রায় বহালের খবর ছড়িয়ে পড়লে শাহবাগে অবস্থানরতরা আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেন। এ সময় তারা বিভিন্ন সেøাগানও দেন। পরে শাহবাগ থেকে একটি আনন্দ মিছিল বের করেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। জাতীয় জাদুঘর থেকে চারুকলা হয়ে শাহবাগ মোড়ে এসে শেষ হয়। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ॥ নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল থাকায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১। বুধবার এক বিবৃতিতে বলা হয়- ফোরাম মনে করে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের এ রায়ের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো নির্মম মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়েছিল, চার দশক পর হলেও তার বিচার হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সমুন্নত হয়েছে মানবতা। নিহত ও আহত মানুষের পরিবার সুবিচায় পেয়েছে। এ রায় বাংলাদেশের নতুন এক বিজয়। ফোরাম মনে করে, এ রায়ের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্তির পথে আরও একধাপ অগ্রসর হবে। সিপিবির সন্তোষ ॥ মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দ- উচ্চ আদালতে বহাল থাকায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সন্তোষ প্রকাশ করেছে। পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ এক বিবৃতিতে এ রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন। জামায়াত নিষিদ্ধ ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি ॥ সর্বোচ্চ আদালতে নিজামীর মৃত্যুদ- বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এক বিবৃতিতে বলেছেন, এ রায় জাতির কাক্সিক্ষত ছিল। প্রবাসীদের সন্তোষ প্রকাশ ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল হোতা ও আলবদর বাহিনীর প্রধান জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের রায় আপীল বিভাগে বহাল রাখায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীরা। বুধবার সকালে আপীলের রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশী কমিউনিটিতে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। পরে এক বিবৃতিতে প্রবাসী বাংলাদেশী নেতারা এ তথ্য জানান। সর্বোচ্চ আদালতের ঘোষিত এ রায়কে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়- এ রায়ে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের ঋণ কিছুটা ভারমুক্ত হলো এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতি আরও একধাপ এগিয়ে গেল। একই সঙ্গে অবিলম্বে এ রায় কার্যকর করাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দ্রুত করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রবাসীরা। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের জেনোসাইড ’৭১ ফাউন্ডেশনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ড. প্রদীপ রঞ্জন কর, আওয়ামী লীগ নেতা হাজী শফিক, মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মিরাজ খান মিরাজ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নূরুন নবী, যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আঃ বাতেন প্রমুখ। এছাড়া বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়েছে।
×