ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুদণ্ড ॥ নিজামীর আপীলের আজ চূড়ান্ত রায়

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৬ জানুয়ারি ২০১৬

মৃত্যুদণ্ড ॥ নিজামীর আপীলের আজ চূড়ান্ত রায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা আমির আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে আপীল আবেদনের চূড়ান্ত রায় আজ বুধবার ঘোষণা করা হবে। প্রধান বিচারপতি এসকে কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করবেন। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। আপীল বিভাগের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় এ মামলাটি রায়ের জন্য এক নম্বরে রাখা হয়েছে। নিজামীর এ মামলার মধ্য দিয়ে আপীল বিভাগে ষষ্ঠ মামলার আপীলে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে। এদিকে আপীল বিভাগে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সুপ্রীমকোর্ট অঙ্গনে বাড়তি নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের রায় দেন তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আলবদর বাহিনীর প্রধান বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে মৃত্যুদ- প্রাপ্ত আসামি জামায়াতের ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ৪ অভিযোগে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। অপর ৪টি অভিযোগের তাকে যাবজ্জীন করাদ- দেয়া হয়। বাকি ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’ সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম (বর্তমানে হাইকোর্টে) ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক (বর্তমান চেয়ারম্যান)। এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর আপীল করা হয়। আপীলে উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ৮ ডিসেম্বর রায় ঘোষণার জন্য ৬ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করা হয়। এদিকে উভয় পক্ষই আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন, তারা ন্যায়বিচার পাবে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, আমি আশা করছি নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- বহাল থাকবে। বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে নিজামীর মৃত্যুদ- বহাল না থাকলে জাতি হতাশ হবে অন্যদিকে আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুবে আলম বলেছেন, আমি আশা করছি নিজামী খালাস পাবেন। নিজামীর মামলাটি আপীল বিভাগে ষষ্ঠ মামলা। ট্রাইব্যুনাল থেকে আপীল বিভাগে আসা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর মধ্যে এর আগে ৫ জনের মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীকে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির দ-ের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছেন আপীল বিভাগ। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম আপীল নিষ্পত্তি হবার আগেও মারা যান সে কারণে তাদের আপীল অকার্যকর হয়ে যায়। নিজামীর মামলায় শুনানি গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চলে ২৫ নবেম্বর পর্যন্ত। পরে ৩০ নবেম্বর নিজামীর আপীলের যুক্তিতর্ক শুরু করে ২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক পেশ শেষ করে। ট্রাইব্যুনালে নিজামীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত আটটি অভিযোগে সাক্ষ্য-প্রমাণ বিষয়ে তিন কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে আসামিপক্ষ। এর বিপরীতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। মোট আপীল বিভাগে নিজামীর মামলাটি ১১তম কার্যদিবসে এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই আপীলের যুক্তিতর্ক। আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাহজাহান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামি পক্ষ ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর আপীল করে। ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট পেশ করে তাতে ১৬৮টি কারণ উল্লেখ করে দ- থেকে খালাস চেয়ে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন এ আপীলটি দাখিল করেন। ১২১ পৃষ্ঠায় মূল আপীল আবেদনের সঙ্গে ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার নথিপত্র দাখিল করা হয়েছে। মূল আপীলে ১৬৮টি গ্রাউন্ড পেশ করে দ- থেকে খালাস চাওয়া হয়েছে। নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ১৬টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে নিজামীকে মৃত্যুদ- দেয় ট্রাইব্যুনাল। ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। এছাড়া ৫, ৯, ১০ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি (খালাস) দেয়া হয়। এক নজরে নিজামীর যত অভিযোগ ॥ জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষ যে সমস্ত অভিযোগ এনেছিল সেগুলো হচ্ছে- অভিযোগ- ১. নিজামী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম হল ইনস্টিটিউটে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। অভিযোগ-২. একাত্তর সালের ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে নিজামী বক্তৃতা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ইসলামের শত্রু হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে প্ররোচনা দেন। অভিযোগ-৩. একাত্তরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে দেয়া এক বক্তৃতায় স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ভারতের দালাল উল্লেখ করে তাদের নির্মূলের আহ্বান জানান নিজামী। অভিযোগ-৪. একাত্তরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর যশোর বিডি হলে আয়োজিত এক সভায় স্বাধীনতাকামী বাঙালী জনগোষ্ঠীকে নির্মূলে তার সহযোগীদের প্রতি আহ্বান জানান। অভিযোগ-৫. একাত্তরের ১৪ এপ্রিল পাবনার সাঁথিয়া থানার বাউশগাড়ী গ্রামে ৪৫০ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে নির্বিচারে হত্যায় নিজামীর বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ। অভিযোগ-৬. একাত্তরের ৮ মে সাঁথিয়ায় সুরেন্দ্র নাথ ঠাকুরের পূজা ঘরের সামনে নিজামীর পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত হয়। অভিযোগ-৭. একাত্তরের ২৭ নবেম্বর পাবনার সাঁথিয়া থানার ধুলাউড়ি গ্রামে আবদুল আওয়ালের বাড়ি ঘেরাও করে ৩০ জনকে হত্যা, বাড়িতে লুট, নারীদের ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ। অভিযোগ-৮. ১৬ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদী থানার আর পাড়া ও ভূতেরগাড়ি গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে লুট, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ হাফেজ ওমর আলীসহ ১৯ জনকে হত্যার অভিযোগ। অভিযোগ-৯. পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা শহীদ মাওলানা কছিম উদ্দিন আহমদসহ তার দুই সঙ্গীকে একাত্তরের ১০ জুন হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিজামী জড়িত। অভিযোগ-১০. পাবনা শহরের নুরপুর ওয়াপদা পাওয়ার হাউজে একাত্তরের ৯ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধা আবদুল মাজেদ ও মোহাম্মদ আলীকে হত্যার ঘটনা। অভিযোগ-১১. ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাবনার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রামের সোহরাব আলী প্রামাণিককে হত্যার ঘটনা। এছাড়া প্রফুল্ল প্রামাণিক, ষষ্টি প্রামাণিকসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭০ জন নর-নারীকে হত্যা, তাদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। অভিযোগ-১২. একাত্তরের আগস্ট মাসে সাঁথিয়া থানার সোনাতলা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কু-ের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটের ঘটনা। অভিযোগ-১৩. মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাক বাহিনীর ক্যাম্প, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে নিজামীর জড়িত থাকার ঘটনা। তিনি নিখিল পাকিস্তানের ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে এ ক্যাম্পে সব সময় গমন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালাতেন। অভিযোগ-১৪. একাত্তরের ৩০ আগস্ট ঢাকার নাখাল পাড়ায় পুরাতন এমপি হোস্টেলে স্থাপিত পাক ক্যাম্পে বন্দী জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আযাদ এদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকিদের নিজামীর নির্দেশে হত্যা করা হয়। অভিযোগ-১৫. পাবনার সাঁথিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে নিজামী জড়িত থাকার ঘটনা। অভিযোগ-১৬. মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দ্বারপ্রান্ত একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে নিজামী জড়িত থাকার ঘটনায় অভিযোগ গঠিত হয়েছে।
×