ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০১:৫১, ২০ জানুয়ারি ২০১৫

ঢাকার দিনরাত

কটেল বোমা আর পেট্রোলবোমায় গত সপ্তাহে বিপর্যস্ত হয়েছে রাজধানী। ঢাকাবাসীদের অনেকেরই ধারণা থাকতে পারে- নাশকতা যা হচ্ছে তা সব ঢাকার বাইরে। বিশেষত পণ্যবাহী ট্রাকে হামলা চালানো হচ্ছে। ঢাকার ভেতরে তেমন কিছু হবে না। ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক টহলের জন্যই এমন ধারণা। তবে এ ধারণাটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন ঢাকায় যাত্রীবাহী বাসেও হামলা হচ্ছে, পেট্রোলবোমা ছোড়া হচ্ছে পুলিশ বহনকারী বাস লক্ষ্য করেও। সক্রিয় অবরোধকারীরা এখন আগুন-শয়তানে রূপান্তরিত হয়েছে। তাদের দেয়া আগুনে পুড়ে যাচ্ছে নিরীহ নাগরিক। কে, কখন, কোথায় এই চোরাগোপ্তা আক্রমণের শিকার হবে তা কেউ জানে না। শনিবার রাতের ঢাকার কয়েকটি নাশকতার খবর খবরের কাগজে এসেছে। সব যে কাগজে আসে না বা আনা সম্ভব হয়ে ওঠে না সে কথা বলতে দ্বিধা নেই। এই যেমন ওই রাতে বাংলামোটর মোড়ের পশ্চিম দিকে, যেখানে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের কার্যালয়, বিকট শব্দে ককটেল ফুটল। দেখলাম কিছুটা জায়গায় ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল। শঙ্কিত পথচারীরা দ্রুত পা চালিয়ে জায়গাটা পেরিয়ে যেতে চাইলেন। গুণী নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনের একটি নাটকের নাম ‘অরক্ষিত মতিঝিল’। সে আমলে মতিঝিলই ছিল ঢাকার প্রধান প্রাণকেন্দ্র। এখন ঢাকার বিপুল বিস্তার ঘটেছে, বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র আর একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। বেঁচে থাকলে নাট্যকার কী লিখতেন- ‘অরক্ষিত ঢাকাসমগ্র’? গলির ভেতর থেকে হুট করে বেরিয়ে কিংবা সাধুবেশে মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে কেউ ক্রিকেট বল ছোড়ার মতো করে পেট্রোলবোমা ছুড়ে দিতে পারছে। এমন অপরাজনীতির সংস্কৃতি দেখে যেতে হবে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশেÑ এটা কি আমরা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলাম! জীবন কি আর থেমে থাকে অশান্ত জনপদে! এত শঙ্কা আর ঝুঁকির ভেতরেও গত সপ্তাহে ঢাকা প্রত্যক্ষ করেছে বহুবিধ আয়োজন। দ্বিতীয় দফা বিশ্ব এজতেমা হয়েছে তিনদিনব্যাপী; আন্তর্জাতিক স্থাপত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে; মাঘের প্রথম দিন থেকেই চলেছে পিঠা উৎসব, ও-লেভেল, এ-লেভেল শিক্ষার্থীরা রাতের বেলা পরীক্ষা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটায় বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে এক বিবাহোত্তর সংবর্ধনা শেষে ফেরার পথে দেখি পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে শত শত অভিভাবক অপেক্ষা করছেন। পরীক্ষা শেষ হলে সন্তানদের নিয়ে ঘরে ফিরবেন। সেদিন অকস্মাৎ হরতাল ডাকায় দিনের পরীক্ষা রাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি একটি পরীক্ষা রাত পৌনে বারোটায়ও শুরু হয়। অবরোধের ভেতর হরতাল ডাকা নিয়ে নাগরিক সমাজে রঙ্গরসও কম হয়নি। অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে হরতাল আর অবরোধের মধ্যে পার্থক্য কী? একটার ভেতর আরেকটা আরোপ করা যায় কিনা। দুটোর ভেতর কোন্টা বেশি আতঙ্কের? আসলে কি দুটোর ভেতর কোন পার্থক্য রয়েছে? উভয়ই জনদুর্ভোগেরই ভিন্ন ভিন্ন নাম। ঢাকার মানুষের ওপর ডবল দুর্ভোগ অবরোধ-হরতাল চাপিয়ে সত্যিই কি কিছু অর্জন করা গেল? পিঠা উৎসবে গান-গল্প ও ভোজ শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে মাঘের প্রথম দিন থেকে চারদিনব্যাপী পিঠা উৎসবের আয়োজন করে জাতীয় পিঠা উদ্যাপন পরিষদ। এটিকে বলা হয়েছে ২১তম জাতীয় পিঠা উৎসব। তবে ‘জাতীয়’ শব্দযুক্ত কোন আয়োজনে পিঠাপ্রেমীদের মনে হতেই পারে যে, ৬৪ জেলার না হোক অন্তত ৩২টি জেলার পিঠার স্বাদ নিশ্চয়ই চাখার সুযোগ থাকবে। ব্যাপারটি অতখানি বড় নয়, তবু উদ্যোক্তারা ধন্যবাদ পাবেন বাংলার ঐতিহ্যকে যথাসাধ্য ধারণ ও প্রসারের উদ্যোগ নেয়ার জন্য। তাছাড়া মঞ্চ থেকে পরিবেশিত হয়েছে লোকসঙ্গীত থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গান। সেই সঙ্গে গল্পচ্ছলে আনন্দ দেয়ার প্রয়াসও ছিল। বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁরা নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আবৃত্তিকারেরা পরিবেশন করেছেন কবিতা। নৃত্যও বাদ পড়েনি। পিঠা উৎসবের পুস্তিকায় এ আয়োজনের পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে : বর্তমান প্রজন্মের কাছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পিঠাকে পরিচিত করার জন্য ২২ বছর আগে সাংস্কৃতিক সংগঠন দৃষ্টি এ আয়োজন শুরু করে। প্রথম দুটো উৎসব আয়োজন করতে সমস্যা হলেও তৃতীয় উৎসব থেকে এর প্রসার ঘটতে থাকে। সাংবাদিক বন্ধুরা সর্বসাধারণের কাছে পিঠা উৎসবের গুরুত্ব তুলে ধরে এর প্রসারে ভূমিকা রাখেন। দৃষ্টি ১৯৯২ সাল থেকে পরপর ১০টি উৎসব এককভাবে উদ্যাপন করে। ১১তম উৎসব থেকে জাতীয় কমিটি করা হয়। শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন সুধাসদনসংলগ্ন লেকের পাড়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় পিঠা উৎসবের উদ্বোধন করেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে ২০তম উৎসবটি উদ্যাপিত হয়। এবারই প্রথম উৎসব কমিটির ব্যানারে পিঠা উৎসব হচ্ছে। উৎসবে প্রদর্শিত ও বিক্রির জন্য তৈরি রকমারি পিঠার মধ্যে ভাপা, পাটিসাপটা, কুলি-পুলি প্রভৃতি কমন পিঠার পাশাপাশি রয়েছে ইলিশ পিঠা, জামাই আদর পিঠা, রূপসী পিঠা, মালাই পিঠা প্রভৃতি। শুক্রবার ছুটির দিনে উৎসবে গিয়ে দেখি মঞ্চের আয়োজন বেশ জমে উঠেছে। একের পর এক নবীন-তরুণ শিল্পী লোকসঙ্গীত পরিবেশন করছেন। পরিবেশন শেষে শিল্পীর হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেয়া হচ্ছে পিঠার থালা। কমিটির সভাপতি ওসমান গনি তাঁর সতীর্থ প্রকাশক মাযহারুল ইসলামসহ স্বজনদের পুরো একটি দল নিয়ে এক স্টল থেকে আরেক স্টলে গিয়ে নানান পিঠার স্বাদ নিচ্ছেন। তিনটে পিঠাঘরের সামনে কিছুটা বেশি ভিড় দেখলাম। এগুলো হলো কুমিল্লা ঐতিহ্য পিঠা ঘর, গোপালগঞ্জ পিঠা ঘর ও লাবণ্য নোয়াখালী পিঠা ঘর। শিশু বিকাশ কেন্দ্র পরিচালিত বাংলার পিঠা প্রাঙ্গণ-এর দুটি স্টল রয়েছে। এক স্টলের সদস্য অন্য স্টলের হাঁড়ি থেকে একটি পিঠা তুলে দৌড় দিলেন। উসুল করতে ওই স্টলের একজন ছুটে গেলেন অন্য স্টলে। পিঠা কাড়াকাড়ি আর পিঠায় কামড় দেয়ার এই মজা চলল কিশোরীদের ভেতর কিছুক্ষণ। উৎসব প্রাঙ্গণে অবশ্য শিশু একাডেমির বইয়ের স্টলও ছিল। তবে বেশ কিছু জায়গার স্টল ফাঁকা পড়েছিল, যা একটি মেলার সৌন্দর্যে বিঘœ ঘটানোর মতোই। যাহোক অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন মঞ্চে উঠে দর্শকদের আনন্দ দিলেন ‘তুমি কাদের কুলের বউ গো’ বাংলা ও ইংরেজীতে দু’চরণ শুনিয়ে। স্টল ছেড়ে পিঠা বানানো বাদ দিয়ে কেউ কেউ ছুটে গেলেন শাওনের গান আর কথা শুনতে। অবাণিজ্যিক প্রকাশনা সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত গ্রন্থ প্রকাশনা আবার অবাণিজ্যিক হয় কিভাবে? বই কি তাহলে বিক্রি হবে না! বিনেপয়সায় বিলানো হবে? নতুন প্রকাশক আবু এম ইউসুফের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি স্পষ্ট হলো। প্রধানত তরুণ লেখকদের পাণ্ডুলিপি আহ্বান করে সম্পাদকমণ্ডলীর অনুমোদনক্রমে তিনি যেসব গ্রন্থ প্রকাশ করছেন সেসব আসন্ন একুশের বইমেলায় অবশ্যই বিক্রি করা হবে। প্রতিটি বইয়ের জন্য তিনি যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছেন তা উঠে এলেই বই বিক্রির বাকি টাকা লেখক পাবেন। তার মানে প্রকাশক এক টাকাও নিজে নেবেন না। গ্রন্থপ্রকাশনায় এমন স্বেচ্ছাসেবকের দৃষ্টান্ত কি আর আছে? আমার জানা নেই। এ বিষয়ে ফেসবুকে ‘অনুপ্রাণন প্রকাশন’-এর পেজে বিশদ তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘অনুপ্রাণন-এও বই প্রকাশের শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে পত্রিকাটির নিয়মিত লেখক এবং যাঁর নিজস্ব কিছু ভক্ত-পাঠক রয়েছেন এমন নবীন-তরুণ দায়িত্বশীল লেখকদের বই প্রকাশ করা হবে। অবশ্য প্রতিষ্ঠিত ক’জন লেখকের গ্রন্থও পাশাপাশি বেরুতে দেখলাম। অনুপ্রাণন প্রকাশনার সেøাগান ‘সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত’। ইতোমধ্যে সতেরোটি বই বেরিয়েছে। এই বইগুলোর লেখকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং নির্বাচিত কিছু বইয়ের আলোচনার জন্য শনিবার পাবলিক লাইব্রেরীর সেমিনার কক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ড. ফজলুল আলম, ড. মাসুদুজ্জামান, মনি হায়দার, এটিএম মোস্তাফা কামাল, পিয়াস মজিদ, রুখসানা কাজল, সরদার ফারুক, ক্যামেলিয়া আহমেদ প্রমুখ আলোচনা করেছেন সদ্যপ্রকাশিত বইগুলো নিয়ে। আর বইয়ের রচয়িতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মঞ্জু সরকার, চৈতী আহমেদ, কুহক মাহমুদ, অঞ্জন আচার্য, মোজাফফর হোসেন, সৈয়দ ওয়ালী, শামীম সাঈদ, কবির য়াহমদ, সোলায়মান সুমন প্রমুখ। সমাপনী বক্তব্য দেন তপন বাগচী। অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন সুলতানা শাহরিয়া পিউ। আলোচনা ও আবৃত্তির ফাঁকে ফাঁকে সংগীত পরিবেশিত হয়। সব মিলিয়ে বেশ উপভোগ্যই ছিল আয়োজন। সত্যি বলতে কি, আমাদের প্রকাশকরা বদলে গেছেন। আগে তাঁরা বই বের করতেন নিজের টাকায়, লেখকদের দিতেন রয়্যালটি। এখন নামীদামী প্রকাশকও লেখকের টাকায় বই বের করে থাকেন। কাগজে-কলমে আইন রক্ষার জন্য লেখকের সঙ্গে চুক্তিপত্র পূরণ করেন। ব্যতিক্রম তো আছেই। সেক্ষেত্রে অনুপ্রাণন-এর উদ্যোগটি প্রশংসাযোগ্য একাধিক কারণে। তরুণ প্রতিভাবান লেখকরা সহজেই বই প্রকাশ করতে পারছেন যদি সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। দ্বিতীয়ত, বই লিখে উপার্জনেরও একটা সুযোগ রয়েছে। তৃতীয়ত, প্রচারণার জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির পত্রিকা তো রয়েছেই।
×