ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অবরোধের পরে কী করবে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫

অবরোধের পরে কী করবে বিএনপি

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বিএনপি-জামায়াত জোটের মনোভাবের কি কোন পরিবর্তন হবে? নাকি হরতাল-অবরোধের নামে চলতেই থাকবে জঙ্গীরূপে চোরাগোপ্তা হামলা, আগুন দেয়াসহ মানুষ হত্যার তৎপরতা। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ডাকে লাগাতার হরতাল-অবরোধে ইতোমধ্যেই জীবন দিতে হয়েছে ২৪জন সাধারণ মানুষকে। অথচ হরতাল-অবরোধ ডেকে নেতারা আছেন হয় গা ঢাকা দিয়ে, না হয় বাসায় এসির ভেতর। টানা নাশকতায় দেশের প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে এখন কেবল একটিই প্রশ্ন। এভাবে কি চলতেই থাকবে কথিত ‘শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচীর নামে নাশকতা? এরপর কি? সরকারই বা কি করছে? মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারছে না সরকার, তবে ক্ষমতায় আছে কেন? আশার কথা, কর্মসূচী থেকে সরে আসার পথ খুঁজছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এজতেমা শেষ হলেই ঢাকায় তিনটি স্থানে জনসভা করতে চায় ২০ দলীয় জোট। জানা গেছে, লাগাতার নাশকতা চালিয়ে মানুষ হত্যার কারণে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হুঁশিয়ারির পর কথিত আন্দোলন থেকে ভালভাবে বের হওয়ার পথ খুঁজছে বিএনপি-জামায়াত জোট। যদিও বিএনপির ঘাড়ে বন্দুক রেখেই দেশজুড়ে নাশকতার মাধ্যমে বড় ধরনের অরাজকতার পাঁয়তারা করছে জামায়াত-শিবির। এজতেমার পর আবার সমাবেশ করতে চায় বিএনপি-জামায়াত ॥ দ্বিতীয় পর্যায়ের এজতেমা শুরু হয়েছে শুক্রবার। শেষ হলেই ঢাকায় জনসভা করতে চায় ২০ দলীয় জোট। সমাবেশের জন্য ১৮ অথবা ১৯ জানুয়ারিকে টার্গেট করেই এগোচ্ছে দলটি। এ সময় পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে বিএনপি-জামায়াতের। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চলমান অবরোধ কর্মসূচীর কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হলেও জোট সন্তুষ্ট। বিশেষত আন্দোলনের মূল শক্তি জামায়াত-শিবির কোনভাবেই কর্মসূচী তুলতে নারাজ। জামায়াত-শিবিরের মনোভাবের কারণে বিশ্ব এজতেমায়ও অবরোধ হরতাল করেছে বিএনপি। জামায়াত-শিবির ইতোমধ্যেই বিএনপিকে নিশ্চিত করেছে, বিশ্ব এজতেমা শেষে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কঠোরতা আরও বাড়াবে তারা। বাড়বে আন্দোলনের গতি। পাল্টাবে ধরন ও কৌশল। অনির্দিষ্টকালের অবরোধ গড়াতে পারে লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনে। রাজধানী ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার পাশাপাশি আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে জামায়াত আরও সক্রিয় হবে বলে খালেদা জিয়াকে নিশ্চিত করেছে। দেশকে চূড়ান্ত সংঘাতে নিতে পারলে তাদের পক্ষে বিদেশী বন্ধূ দেশের অবস্থান নেয়া সহজ হবে বলেও বিএনপিকে জানিয়েছেন জামায়াত নেতারা। এছাড়া নিজেদের দলের নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দেয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সন অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন জামায়াত-শিবিরের ওপর। তাদের অবস্থান যেদিকে থাকছে খালেদা জিয়া সেভাবেই কর্মসূচি দিতে চান। তাই মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি পূরণ অথবা আলোচনার জন্য সরকারকে বাধ্য করার পরিস্থিতি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান বিএনপি চেয়ারপার্সন। লন্ডন থেকে চলমান আন্দোলনের মনিটর করছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি নিয়মিত কমপক্ষে ৬ জন নেতার সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। দিচ্ছেন দিক-নির্দেশনা। এক সপ্তাহে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ॥ জানা গেছে, বিএনপির-জামায়াতের লাগাতার হরতাল-অবরোধে যানবাহনে আগুন, সন্ত্রাস, বোমাবাজিসহ সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হচ্ছে সরকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে বিশেষ অভিযানে নামানো হতে পারে। জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে শীর্ষ নেতাদের গণগ্রেফতারসহ যৌথবাহিনীর মাধ্যমে পরিচালনা করা হতে পারে বিশেষ অভিযান। সূত্রগুলো বলছে, এক সপ্তাহের মধ্যে যে কোন মূল্যে সারাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যা যা করণীয় তার সব কিছুই করবে সরকার। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশকিছু সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এদিকে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের বাড়িতে বৃহস্পতিবার রাতে এক হয়েছিলেন ঢাকায় পশ্চিমা আটটি দেশের কূটনীতিকরা। জোটের অবরোধে সহিংসতা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে সরকারের অবস্থান জানার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বৃহস্পতিবার বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরামের সদস্য মঈন খানের বাসায় তাদের সঙ্গে অষ্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। বিএনপি নেতাদের মধ্যে মঈন খানের সঙ্গে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া ও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মুশফিকুর রহমান। তবে বিএনপির একটি সূত্র জানায়, বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি ও সঙ্কট উত্তরণের বিষয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এই সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে ইউরোপের দেশগুলোর। বিএনপি নেতাদের বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয়ার কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অবরোধে সহিংসতার কারণে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এ বলেছেন, এ সপ্তাহের মধ্যে এই আন্দোলন থেমে যাবে। এদের সঙ্গে আর কোন সংলাপও হবে না। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, হরতাল-অবরোধের নামে যারা মানুষ হত্যা করে, তারা কোন রাজনৈতিক দল নয়, আসলে তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সাধারণ মানুষের ওপর পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করছে, যা করুণ ও বেদনাদায়ক এবং চরম নিন্দনীয়। অন্যদিকে অবরোধের মতো কর্মসূচী ‘সংবিধান পরিপন্থী’ মন্তব্য করে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তারা নাশকতা ও সন্ত্রাস রুখে দেবেন। ২০১৩ সালের মতো এবারও কোন ‘অন্যায় যুদ্ধকে’ ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। রংপুরের মিঠাপুকুরে বাসে আগুন দিয়ে পাঁচ যাত্রীকে হত্যার ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে শুক্রবার এক মতবিনিময় সভায় তাঁরা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, অবরোধের নামে মানুষকে জিম্মি করা গণতন্ত্র নয়। ‘যুদ্ধাপরাধী শক্তির উত্থান’ জাতির জন্য ‘ভয়ঙ্কর’ মন্তব্য করে পুলিশ প্রধান বলেন, যানবাহনে আগুন দেয়া, পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা সত্যিকারের রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। এজতেমা ঘিরে নাশকতার আশঙ্কা ॥ দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব এজতেমা ঘিরে রাজধানীতে তিনটি স্থানে সমাবেশের অনুমতি চাইতে পারে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। সমাবেশের অনুমতি না পেলে এজতেমাকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি ও আখেরি মোনাজাতে মুসল্লিদের আগমনে বাধা দিতে পারে জোটটিÑ এমন আশঙ্কা গোয়েন্দা সংস্থার। সরকারের এক গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ব এজতেমাকে সামনে রেখে আগামী ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, প্রেসক্লাব কিংবা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি চাইবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটটি। সমাবেশের অনুমতি না পেলে বিশ্ব এজতেমার আখেরি মোনাজাতের দিন এজতেমাস্থলে আসার সকল মহাসড়কে অবস্থান করে মুসল্লিদের বাধা দেয়া ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করবে জোটটি। সেখান থেকে তারা বিএনপির চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় অভিমুখে যাত্রা করতে পারে বলেও গোয়েন্দা সংস্থার আশঙ্কা। সেক্ষেত্রে মুসল্লিদের এজতেমায় আসার পথে বিঘœ সৃষ্টি হওয়াসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য আগে থেকেই গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখাসহ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাইরে হুঙ্কার দিলেও আসলে সরে আসার পথ খুঁজছে বিএনপি ॥ টানা অবরোধ কর্মসূচী থেকে সরে আসার পথ খুঁজছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এতদিন কঠোর অবস্থানে থাকলেও নেতাকর্মীরা মাঠে না নামার কারণে কর্মসূচী সফল না হওয়া এবং এ কর্মসূচীর কারণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়ায় এখন তিনি অবস্থান পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন। তবে রাজনৈতিকভাবে নিজ দলের অবস্থান দুর্বল না করে কিভাবে অবরোধ কর্মসূচী থেকে বের হয়ে আসা যায় তার জন্য বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি উপায় খোঁজার চেষ্টা করছেন তিনি। সূত্র মতে, সরকারের তরফ থেকে আলোচনার উদ্যোগ কিংবা শীঘ্রই রাজধানীতে একটি সমাবেশ করার অনুমতি দিলে গুলশান কার্যালয় থেকে বাসায় ফিরে যাবেন খালেদা জিয়া। এদিকে টানা অবরোধ ডেকে কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না নামলেও পিকেটারদের দিয়ে নাশকতা চালিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে পড়েছে বিএনপি। এমনকি দলের একটি অংশও বিএনপি হাইকমান্ডের প্রতি নাখোশ হয়েছে। তারপরও জামায়াত-শিবিরের দাবি ও লন্ডন থেকে দেয়া বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কঠোর নির্দেশনার কারণেই বিএনপি এ কর্মসূচী অব্যাহত রেখেছে। এ কর্মসূচী যাতে মাঠে মারা না যায় সেজন্য বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখনও তার সঙ্গে যারা দেখা করতে যাচ্ছেন তাদের কাছে অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন।
×