
ছবি: সংগৃহীত
চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ-খাজুরিয়া সড়কে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া আদায়ে চলছে নৈরাজ্য। অতিরিক্ত ভাড়া, অনিয়ন্ত্রিত চলাচল, ভাড়া নির্ধারণে কোনো নিয়ম না থাকা এবং প্রশাসনের তদারকির অভাবে দীর্ঘদিন ধরেই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সাধারণ যাত্রী, শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষ। এবার তাঁদের পক্ষ থেকে উঠেছে সুসংগঠিত দাবি—রুটভিত্তিক নির্ধারিত ভাড়া তালিকা তৈরি করে প্রতিটি স্ট্যান্ডে তা প্রকাশ ও নিয়মিত মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে।
চাঁদপুর লঞ্চঘাট, ফরিদগঞ্জ, রুপসা ও খাজুরিয়া রোডে যাত্রী পরিবহনে সিএনজি চালকদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ নতুন নয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, গণমাধ্যমে একাধিকবার সংবাদ প্রকাশিত হলেও বাস্তবসম্মত কোনো ব্যবস্থা আজও দেখা যায়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসায় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ শুরু হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে অনলাইন গণমাধ্যম ‘লক্ষ্মীপুর ২৪ ডটকম’-এ লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসনের এক উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন বেশ আলোচিত হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সিএনজিচালিত অটোরিকশার রুটভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করে স্ট্যান্ডে তা প্রকাশ করেছে জেলা প্রশাসন। এই সংবাদের পর চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জেও শুরু হয় আলোড়ন, সচেতন নাগরিকরা প্রশ্ন তুলছেন—চাঁদপুরে এ ধরনের উদ্যোগ কবে?
ফরিদগঞ্জ থেকে খাজুরিয়া পর্যন্ত রোডের দৈর্ঘ্য প্রায় ৯–১০ কিলোমিটার। আগে রাস্তা ভাঙাচোরা থাকায় চালকরা ঘুরপথে চলাচল করতেন, আর সেই অজুহাতে ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ভাড়া করা হয়েছে ৫০ টাকা। বর্তমানে রাস্তা মেরামতের ফলে ভ্রমণের সময় কমেছে(সর্বোচ্চ ১৫মিনিট), কিন্তু ভাড়া কমেনি—বরং ঈদের সময় এই ভাড়া ৭০–৮০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়।
অথচ কাছাকাছি দূরত্বের অন্যান্য রুটে তুলনামূলকভাবে কম ভাড়া নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, খাজুরিয়া থেকে কাটাখালি (৯ কিমি) ৩০ টাকা, কাটাখালি থেকে হাজীগঞ্জ (১২ কিমি) ৩০ টাকা, হাজীগঞ্জ থেকে রামগঞ্জ বা চাঁদপুর রুটেও এর চেয়ে কম ভাড়া নির্ধারিত আছে। এতে স্পষ্ট হয় যে, চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ
-খাজুরিয়া রুটে কোনো ধরনের নিয়ম মানা হচ্ছে না।
ফরিদগঞ্জ থেকে চাঁদপুর লঞ্চঘাট পর্যন্ত সাধারণ সময়ে ভাড়া আদায় করা হয় জনপ্রতি ৮০ টাকা, যা ঈদ বা বিশেষ সময়ে বেড়ে দাঁড়ায় ১০০–১২০ টাকা পর্যন্ত। অথচ কিছু বছর আগেও এই রুটের ভাড়া ছিল মাত্র ৫০ টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দা, সচেতন যাত্রী ও শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী বর্তমান বাস্তবতায় নিচের মতো একটি ভাড়ার তালিকা গ্রহণযোগ্য, নায্য ও বাস্তবসম্মত হতে পারে। যেমন: খাজুরিয়া → আমিরা বাজার/বোয়ালিয়া: ১০ টাকা, খাজুরিয়া → রুপসা: ২০ টাকা, খাজুরিয়া → ফরিদগঞ্জ: সর্বোচ্চ ৪০ টাকা, ফরিদগঞ্জ → চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড/স্টেডিয়াম রোড/বঙ্গবন্ধু সড়ক: ৫০ টাকা, ফরিদগঞ্জ → চাঁদপুর লঞ্চঘাট: সর্বোচ্চ ৬০ টাকা, খাজুরিয়া → চাঁদপুর লঞ্চঘাট (প্রায় ৩০ কিমি, ৪৫ মিনিট): সর্বোচ্চ ১০০ টাকা।
এই হিসাবে দেখা যায়, একজন চালক খাজুরিয়া সিএনজি স্টান্ড থেকে চাঁদপুর লঞ্চঘাট একটি ট্রিপে ৫ জন যাত্রী নিয়ে ৩০ কিমি এবং ৪৫-৫০ মিনিটের রাস্তায় ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। এই ৫০০ থেকে গ্যাস ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়েও চালকদের হাতে থাকে যুক্তিসঙ্গত লাভ। তাহলে প্রশ্ন জাগে—এই আয়ের পরও কেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায়?
ভাড়ার এই অরাজকতার পেছনে রয়েছে চালকদের অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতা, ওভারটেকিং প্রবণতা, বেপরোয়া গতি এবং অদক্ষ চালকদের সক্রিয়তা। অনেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, যানবাহনের ফিটনেস নেই, এমনকি অনেক গাড়িতে নেই হেডলাইট, ব্রেক, হর্ণ বা লুকিং গ্লাস। থাকলেও অনেকাংশ অকার্যকর। এসব কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে গত কয়েকবছরে এই রুটে দূর্ঘটনা অনেক বেড়েছে। অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
ভাড়ার বিষয়টি নিয়ে গেল ঈদুল আযহা পরবর্তী সোশ্যাল মিডিয়ার ফের আওয়াজ উঠলে গত ২০ জুন (শুক্রবার) সন্ধ্যায় ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা রাজিয়া যৌথ বাহিনী নিয়ে ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালান। সেখানে অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং মহিলা যাত্রীদের সঙ্গে শালীন আচরণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়। তবে সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, এসব নির্দেশনার বাস্তব প্রয়োগ নেই বললেই চলে। প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে চালকরা পুরোনো নিয়মেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে যাচ্ছেন।
সমাধান হিসেবে যদি রুটভিত্তিক সিএনজি ভাড়া নির্ধারণ ও তা তালিকা আকারে প্রকাশ করা হয়, প্রতিটি স্ট্যান্ডে সেই তালিকা দৃশ্যমান স্থানে টানানো, নিয়মিত মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, চালকদের প্রশিক্ষণ ও বৈধ লাইসেন্স নিশ্চিতকরণ, যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা ও সনদ বাধ্যতামূলক করা।
এমন উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে শুধু সিএনজি ভাড়া নয়—চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ রোডে শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি—ভবিষ্যতের চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ রোড হোক ন্যায্য, নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল।
আঁখি