ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

ইন্দুরকানীতে টেকসই বেড়িবাঁধের অভাব, ঝুঁকিতে লক্ষাধিক মানুষ

কামরুল আহসান (সোহাগ), ইন্দুরকানী, পিরোজপুর:

প্রকাশিত: ১৩:৫৭, ২২ জুন ২০২৫

ইন্দুরকানীতে টেকসই বেড়িবাঁধের অভাব, ঝুঁকিতে লক্ষাধিক মানুষ

ছবি: সংগৃহীত

পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার কচা ও বলেশ্বর নদীবেষ্টিত এলাকার অধিকাংশ স্থানেই পর্যাপ্ত ও টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় জলবায়ু বিপর্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন লক্ষাধিক মানুষ। প্রতি বর্ষা মৌসুম ও ঘূর্ণিঝড়ের সময় এসব অঞ্চলের মানুষের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভোগ।

১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ইন্দুরকানী উপজেলার সাঈদখালী গ্রামের আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইন্দুরকানীর দীর্ঘ এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে ইন্দুরকানীর সকল বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। সিডরের ভয়াবহ তাণ্ডবে মারা যায় প্রায় অর্ধশতাধিক লোক। নিখোঁজ হয় শতাধিক বাসিন্দা, যাদের আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর পর থেকে এ অঞ্চলের বেড়িবাঁধের উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কার করা হয়নি।

এ বিষয়ে ইন্দুরকানী উপজেলা পরিষদের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদী জানান, ‘আমার আব্বা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’র নিজ হাতে গড়া এই উপজেলায় যাতে কোন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড না হয়, সেজন্য গত ১৫ বছর ধরে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে পলাতক হাসিনা সরকারের সহযোগিরা। এজন্য এই এলাকায় কোন টেকসই বেড়িবাঁধ আজ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়নি। ফলে বেড়িবাঁধের অভাবে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। এই উপজেলায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য আমি সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে এলাকার বেশিরভাগ বাঁধ ভাঙা ও জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। নদীর স্রোত বাড়লেই সেসব বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। বিশেষ করে টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এর আঘাতে উপজেলার বালিপাড়ার সাঈদখালী বাজার থেকে কালাইয়া আবাসন পর্যন্ত দীর্ঘ এক কিলোমিটার জায়গার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিলিন হয়ে গেছে।

এছাড়া, বেড়িবাঁধ না থাকায় চন্ডিপুর, বালিপাড়া,  চাড়াখালী, ইন্দুরকানী, চরবলেশ্বর, কালাইয়া, কলারনের নদী পাড়ের মানুষ জোয়ারের পানি ও বন্যায় প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ইন্দুরকানী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদ করিম তালুকদার ইমন জানান, জোয়ারের পানি সামান্য বৃদ্ধি পেলেই নদী তীরবর্তী এলাকায় ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট সবকিছুই প্লাবিত হয়। বিশেষ করে টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় চরমভাবে নদী ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে ইন্দুরকানী উপজেলা ভূমি অফিস, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সসহ ইন্দুরকানী বাজারের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। এসব স্থাপনা যেকোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সাঈদখালী গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, ইন্দুরকানীর প্রধান জীবিকা কৃষি ও মৎস্য চাষ। তবে বেড়িবাঁধ না থাকায় ফসলের মাঠে নোনা পানি ঢুকে পড়ছে; এতে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে এবং উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মাছের ঘেরগুলোও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বলেশ্বর নদী পাড়ের চাড়াখালী গ্রামের আবাসনের বাসিন্দা সোহাগ কাজী বলেন, ‘সামান্য জোয়ারেই আমাদের ঘরগুলোতে পানি উঠে যায়, রান্নার চুলাও পানিতে ডুবে থাকে। বর্ষা মৌসুমে অনেক সময়ই না খেয়ে থাকতে হয় আবাসনের লোকদের।’

কচা নদীর পাড়ের কালাইয়া আবাসনের বাসিন্দা শারমিন আক্তার জানান, ঝড়-বন্যার সময় ছোট শিশুদের নিয়ে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই আবাসনের আশেপাশে। তাই জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলে সবাইকে আতঙ্কে থাকতে হয়। এখানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা খুব জরুরি।

ইন্দুরকানী উপজেলার নদী তীরবর্তী লক্ষাধিক মানুষ আজ প্রকৃতির করুণার ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এসব মানুষের জীবন-জীবিকার স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। নাহলে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে নতুন করে দুর্ভোগ পোহাতে হবে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের।

ইন্দুরকানী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হাসান বিন মুহাম্মদ আলী জানান, ‘নদী তীরবর্তী জনগণের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাঁধ খুব দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে।’

কামরুল আহসান (সোহাগ)/রাকিব

×