ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

বিলুপ্তির পথে ঢেঁকি, হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার এক চিরচেনা গ্রামীণ ঐতিহ্য

এবিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৮:০৫, ২০ জুন ২০২৫

বিলুপ্তির পথে ঢেঁকি, হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার এক চিরচেনা গ্রামীণ ঐতিহ্য

ছবি:সংগৃহীত

এক সময় গ্রামবাংলার প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতে চাল ভাঙার জন্য ছিল কাঠের তৈরি একটি অপরিহার্য যন্ত্র—ঢেঁকি। এই ঢেঁকি শুধু ধান থেকে চাল তৈরি নয়, ছিল আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং নারীশ্রমনির্ভর গ্রামীণ জীবনের এক অমূল্য প্রতিচ্ছবি। কালের পরিবর্তনে, যান্ত্রিক আধুনিকতার দাপটে আজ প্রায় হারিয়ে গেছে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী যন্ত্র।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের অনেক প্রবীণই ঢেঁকির স্মৃতি মনে করে চোখে জল আনেন। ৭০ বছর বয়সী মোছাঃ জাহানারা বেগম বলেন, “এক সময় গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঢেঁকি ছিল। নারীরা ঢেঁকিতে ধান ভেঙে চাল বানিয়ে সংসার চালাতেন। কারো বাড়িতে নতুন কুটুম বা জামাই এলে ঢেঁকির ধুমধাম শব্দ শোনা যেত।”

তিনি আরও বলেন, “ঢেঁকিতে তৈরি চালের ভাত কিংবা পিঠার স্বাদ ছিল একেবারে অন্যরকম। শীত এলেই ঢেঁকির গুঁড়া চাল দিয়ে তৈরি হতো নানা পিঠা—রসের পায়েস, শিয়ে পিঠা, পুলি, চিতল, মেরা, দুধ-খেজুর, পাক্কন, চিকন পিঠা এমনকি দুইবিরানী পিঠাও। সেসময় শহরের আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত ছুটে আসত গ্রামে, শুধু পিঠা খাওয়ার জন্য।”

ঢেঁকি শুধু রান্নার উপকরণ তৈরির একটি মাধ্যম ছিল না, ছিল নারীদের সামাজিক মেলবন্ধনেরও অংশ। দল বেঁধে ঢেঁকিতে ধান ভাঙতেন নারীরা। ক্লান্তি ভুলে তারা মুখে তুলতেন সুর, গাইতেন গান, চলত গল্প-কথা, হাসি-ঠাট্টা।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আজ ধান ভাঙছে যন্ত্রে। ঢেঁকি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে সেই শব্দ, সেই আড্ডা, সেই উৎসবের আমেজ। গ্রামীণ জীবনের আরও অনেক অনুষঙ্গ—কুলা, লাঙল, মই, জোয়াল, ঘুড়ি—আজ কেবলই স্মৃতির পাতায়, বা ক্যালেন্ডারের ছবিতে।

ঢেঁকির গঠনও ছিল খুব সুনিপুণ। সাধারণত ছয়-সাত হাত লম্বা কাঠের খণ্ড, যার এক পাশে বসানো হতো লোহার পাত বা ‘গুলো’। মাটিতে খুঁড়ে তৈরি হতো গোল গর্ত, যাকে বলা হতো ‘নোট’। কাঠের বিভিন্ন অংশ যেমন মোনাই, গইড়া, কাতলা, গোঁজা দিয়ে তৈরি হতো ঢেঁকির পূর্ণ কাঠামো। একজন ঢেঁকিতে পা দিয়ে চাপ দিতেন, অন্যজন চাল সরাতেন—একটি সমবায়ী প্রক্রিয়ায় চলত এই কার্যক্রম।

বর্তমানে এমন ঢেঁকি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেও দেখা মেলে না ঐ কাঠের তৈরি ঐতিহ্যটির। নতুন প্রজন্ম অনেকেই জানেই না কী ছিল এই ঢেঁকি, কেমন ছিল তার ব্যবহার।

এ যেন শুধু একটি যন্ত্র নয়, এক যুগের জীবনধারার চিহ্ন। তাই প্রয়োজন এখনই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া। না হলে ঢেঁকির মতো আরও অনেক গ্রামীণ স্মারক বিলীন হয়ে যাবে সময়ের অতল গহ্বরে।

মারিয়া

×