
দৈনিক জনকণ্ঠ
একদিকে উন্নয়নের প্রতীক, অন্যদিকে মৃত্যুঝুঁকির মহাসড়ক, পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে নির্মিত এশিয়ান হাইওয়ে যেন এখন দুটি বিপরীত চিত্রের প্রতিচ্ছবি।
তেতুলিয়া থেকে পঞ্চগড় হয়ে দেবীগঞ্জ ও সৈয়দপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এই করিডোরটি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপনের একটি সম্ভাবনাময় পথ। কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বলছে, এটি পরিণত হয়েছে এক অনিয়ন্ত্রিত, অনিরাপদ ও প্রায় অচল সড়ক ব্যবস্থায়।
অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক, লাইসেন্সবিহীন ট্রাক্টর: চলন্ত মৃত্যুকূপ
সরেজমিনে দেখা গেছে, এই হাইওয়েতে চলাচলকারী অধিকাংশ ট্রাক্টরের চালকই অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন। তারা চালনা করছেন বেপরোয়া গতিতে, নেই ট্র্যাফিক নিয়মের ধারণা, নেই পথচারী সুরক্ষার সচেতনতা। স্থানীয় এক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “রাস্তায় নামা মানেই যেন একেকটা লটারি কে কখন ট্রাক্টরের নিচে পড়বে বলা মুশকিল।”
যত্রতত্র অবৈধ বালু পয়েন্ট: হাইওয়ের পরিণতি মরুভূমি
মহাসড়কের পাশে গজিয়ে উঠেছে একের পর এক অবৈধ বালু উত্তোলন কেন্দ্র। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব পয়েন্ট থেকে ট্রাক্টরে বালু অপসারণ করা হচ্ছে নিয়মিত। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ধুলাবালি, ট্র্যাফিক জ্যাম এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি। স্থানীয় পরিবেশ যেমন হুমকির মুখে, তেমনি সৌন্দর্য হারাচ্ছে পুরো অঞ্চল।
ইটভাটার জঞ্জালে বন্দি হাইওয়ে:
এই হাইওয়ের আশপাশে অসংখ্য ইটভাটা গড়ে উঠেছে। সেসব ভাটায় ইট পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে নিয়মবহির্ভূত ট্রাক্টর ও ভারী যানবাহন। অতিরিক্ত লোডে চলাচলের ফলে রাস্তার পিচ উঠে যাচ্ছে, কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে গভীর গর্ত। এতে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা, বেড়েছে যানজট ও জনদুর্ভোগ।
দেবীগঞ্জের মত ব্যস্ততম শহরে নেই ট্র্যাফিক পুলিশ
সবচেয়ে হতাশাজনক চিত্র দেখা যায় দেবীগঞ্জ উপজেলায়। এটি হাইওয়ের একটি ব্যস্ততম পয়েন্ট হলেও এখানে নেই কোনো ট্র্যাফিক পুলিশ। ফলে স্কুলগামী শিশু থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারী সবাই রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। যানবাহনের অরাজক চলাচলের বিরুদ্ধে মাঠপর্যায়ে কার্যকর তদারকি নেই বললেই চলে।
জনগণ এখন আর উন্নয়নের সুফল নয়, বরং প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয় বয়ে বেড়াচ্ছে।
সওজ জানায়: ট্রাক্টর পণ্য পরিবহনে সম্পূর্ণ অবৈধ
সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) পঞ্চগড়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সুলতান মাহমুদ বলেন, “ট্রাক্টর শুধু কৃষিকাজে ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। মহাসড়কে পণ্য পরিবহণ সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ছাড়া অদক্ষ চালক ও লাইসেন্সবিহীন কিশোরদের জন্য দুর্ঘটনার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।” তিনি আরও জানান, এসব কার্যক্রম বন্ধে এখনই প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
উন্নয়নের স্বপ্নে অচল বাস্তবতা:
চার দেশের সংযোগকারী এশিয়ান হাইওয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবাহের প্রতীক হতে পারত। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, অবৈধ যান চলাচল, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং নীতিহীনতা এই সড়কটিকে এখন এক ‘মরণফাঁদে’ পরিণত করেছে।
সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এই ‘সোনার রাস্তা’ অচিরেই রূপ নিতে পারে আরেকটি জাতীয় ট্র্যাজেডিতে।
হ্যাপী