
আন্তর্জাতিক সহায়তা কমায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা
আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গাদের আর্থিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়ায় ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন প্রকার সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। দিন যত যাচ্ছে রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে পড়ছে, যা বাংলাদেশের জন্য হুমকি।
বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে করা বাংলাদেশ-মিয়ানমার: রোহিঙ্গা বিদ্রোহের ঝুঁকি’ শীর্ষক এশিয়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে এ রিপোর্ট প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আর্থিক সংকটের কারণে বাংলাদেশে অবস্থানরত শরণার্থীরা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও পিছু হঠবে না। তাদের নিরাপদ বাসস্থানের জন্য প্রয়োজনে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মনস্থির করবে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা যুবকরা একত্রিত হওয়া শুরু করেছে। রোহিঙ্গাদের এ বিদ্রোহ মিয়ানমারে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্ককে ভয়াবহ ক্ষতি ও সেখানে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এমন পরিস্থিতিতে ক্রাইসিস গ্রুপের রিপোর্টে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কেও তথ্য প্রকাশ করেছেন যে, এমতাবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় অনেক । তন্মেধ্যে বাংলাদেশ রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক ত্রাণ সহায়তা ও সীমান্ত বাণিজ্য জোরদার করার তাগিদ দেয়। এসইসঙ্গে নিজ দেশের রোহিঙ্গাদের মধ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব কমানোর জন্য সরকারিভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রমকে জোরদারের পরামর্শ দেয় তারা।
ক্রাইসিস গ্রুপ জানায়, ধর্মকে ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের যুবক শ্রেণি আরাকান আর্মির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা। প্রতিবেদনটিতে আরও জানানো হয়, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে যখন আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে এগোতে শুরু করে, তখন সংখ্যায় কম থাকা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের সঙ্গে মিলে লড়াইয়ের জন্য রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের মোতায়েনের চেষ্টা করে। সামরিক বাহিনী জোর করে রোহিঙ্গা পুরুষদের মিলিশিয়া ইউনিটে নিয়োগ করে, স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের জন্য সম্প্রদায়টির নেতাদের সঙ্গে কাজ করে এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে।
এই গোষ্ঠী আগে দৃশ্যত রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। রোহিঙ্গা মোতায়েন আরাকান আর্মির অগ্রযাত্রাকে ধীর করে দেয়। কিন্তু সামরিক বাহিনী এটিকে পুরোপুরি প্রতিহত করতে পারেনি। অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল।
রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী ও আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গেই দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা গোষ্ঠীদের ‘ঐক্যের’ উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছে। যদিও সংস্থাগুলো জোর দিয়ে বলছে, তাদের উদ্দেশ্য শিবিরগুলোতে সহিংসতা কমানো। তবে মনে হচ্ছে, তারা আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার একটি উপায় হিসেবে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করছে। তারা গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে কোনো সহায়তা দিচ্ছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এসব নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর এই সম্পৃক্ততা বাংলাদেশ সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে শুর হওয়া আলোচনার সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলছে। আরাকান আর্মি এখন সেসব পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখান থেকে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছিল।
আরাকান আর্মির ওপর রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে জনমতকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি সে দেশে নাগরিকত্বসহ পূর্ণ অধিকার অর্জনে তাদের সংগ্রামকে দুর্বল করে দেবে। আরাকান আর্মি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা দেশজুড়ে তাদের প্রতি সমর্থন বাড়িয়েছে। আরাকান আর্মির বিরোধিতা করাকে মিয়ানমারের অনেকের চোখে সেনাবিরোধী সংগ্রামের ‘ভুল’ দিকে রোহিঙ্গাদের দাঁড় করাবে। এর ফলে জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে, নির্যাতনের হুমকি বাড়বে এবং শেষ পর্যন্ত দেশটির বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনের সংস্কারের প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে।
ক্রাইসিস গ্রুপের পরামর্শ, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়ানো; একইসঙ্গে রাখাইন রাজ্যে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য ও মানবিক সহায়তা বাড়াতে কাজ করা, যা জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় স্থিতিশীলতা আনতে পারে। ঢাকা ও তার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোরও উচিত শিবিরে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা চালানো এবং নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করা।