ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

শান্ত পাহাড়ে প্রতিদিন যুদ্ধ: শেরপুরের পাহাড়ি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম

‎আব্দুল্লাহ্ খান, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ১৫:২১, ১৮ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৭:৫১, ১৮ জুন ২০২৫

শান্ত পাহাড়ে প্রতিদিন যুদ্ধ: শেরপুরের পাহাড়ি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম

ছবি: জনকণ্ঠ

‎বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা শেরপুর। জেলার পশ্চিম প্রান্তে গারো পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পাহাড়ি গ্রামের জীবন। কোথাও গারো, কোথাও হাজং, কোথাও কোচ জনগোষ্ঠীর শতবছরের বসবাস। কিন্তু এই বসবাস এখন আর জীবনের নয়, বরং মৃত্যুর অপেক্ষা।

‎কারণ প্রতিরাতে এই পাহাড়ি জনপদে নামে এক ভয়ংকর আতঙ্ক—বন্য হাতির দল। তারা আসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধ্বংস করে ঘরবাড়ি, খেয়ে ফেলে ফসল, পিষে মেরে ফেলে মানুষ। এই ভয় এখন নিয়মিত। কিন্তু সরকার বা প্রশাসন—তারা যেন কিছুই দেখছে না।

‎এই যে "প্রতিদিন মৃত্যুর শঙ্কা, প্রতিরাত বাঁচার লড়াই, প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের অবহেলা"—দেখার কেও নেই।

‎পাহাড়ের জীবনের ব্যাকরণ: চাষাবাদ নয়, টিন পেটানো, মশাল জ্বালানো 

‎দিনে গারো পাহাড়ের পাদদেশে মানুষ চাষ করে। ধান, কাঁচামরিচ, বাদাম, আদা। তবে চাষ নয়, এখানে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে পাহারা। কারণ সন্ধ্যার পরেই বদলে যায় এই জনপদের মানচিত্র। রাত নেমে এলেই হাতে টর্চ, বাঁশের মাথায় টিন ঝুলিয়ে , মশাল জ্বালিয়ে পাহাড়া দিতে হয়। টিন পেটানোই এখানে জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টা।


‎নালিতাবাড়ীর কলসিন্দুর গ্রামের কৃষক রমিজ উদ্দিন বললেন, “এখানে সরকার আসে না, নেতা আসে না, কিন্তু হাতি আসে। আসে রাতে, কখনো দিনে। ধান রোপণ করে যদি সময়মতো কাটতে পারি, তবেই বাঁচি। তা-ও রাতে জেগে পাহারা দিতে হয়।” তাঁর গলা কাঁপছিল।

‎প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৫-৬টি গ্রামে হাতির দল আসে। স্থানীয়রা জানায়, নভেম্বর থেকে মার্চ—এই সময়েই সবচেয়ে বেশি হামলা হয়। কিন্তু বছরের বাকি সময়টাও হাতি আসে না, এমন নয়।

‎গত ১০ বছরে শেরপুরের ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় মারা গেছে অন্তত ৩৫ জন মানুষ। আহত হয়েছে শতাধিক। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকার থেকে স্থায়ী নিরাপত্তা বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

‎‘আমাদের মরার কোনো খবর ঢাকা পৌঁছায় না’

‎পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট:
‎“একটা হাতি মারা গেলে তদন্ত হয়, মামলা হয়, সংবাদ হয়। কিন্তু একটা মানুষ মারা গেলে কয়েকটা কাগজ আর কয়েকটা ফাইল ঘোরে, ব্যস।”

‎হাতির পায়ে পিষে মারা গেলে একটা প্রতিবেদন করতে হয়—গ্রামপুলিশ থেকে বন বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা প্রশাসন। এরপর ‘সাহায্য’ আসে—১০ হাজার টাকা, ২০ হাজার টাকা। এর বেশিও নয়। কারও ছেলে মরলে কি এই টাকায় সংসার চলে? উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিরুদ্ধে চলে আসে বন আইনে অভিযোগ—তারা নাকি হাতিকে উত্তেজিত করেছে!

‎বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে হাতির স্বাভাবিক চলাচলের করিডোর রয়েছে মোট ১২টি, যার মধ্যে শেরপুর অঞ্চলে অবস্থিত গারো পাহাড়ের করিডোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই পথেই এখন বসতি, বাজার, স্কুল। এর ফলে বন্য হাতির দল বাধা পেলে হয়ে পড়ে হিংস্র।

‎২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে শেরপুরের পাহাড়ি অঞ্চলজুড়ে হাতির আক্রমণে নিহতের সংখ্যা অন্তত ৩৫। আহত হয়েছেন ১৫০ জনের বেশি। প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গড়ে ৩০০–৫০০ বিঘা ফসলি জমি।

‎বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিষয়টা জটিল। একদিকে মানুষের বসতি বৈধ নয়, অন্যদিকে হাতিকে তো আর থামিয়ে রাখা যায় না। আমরা চাই সহাবস্থান। কিন্তু রাজনৈতিক এবং সামাজিক চাপের কারণে কোনো সমাধান টেকসই হয়ে উঠে না।”

‎হাতির করিডোর ধ্বংস: দায় কার?

‎হাতির করিডোর ধ্বংসের জন্য দায়ী নানা নাম। উন্নয়ন প্রকল্প, বন উজাড়, জমি লিজ, মাছ চাষের প্রকল্প, ও কৃষিবিস্তারের নামে পাহাড়ি ভূমি দখল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ভূমি দখলের বেশিরভাগ কাজ হচ্ছে সরকারি সংস্থার অনুমোদন নিয়ে। স্থানীয় বন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়ায় গজিয়ে উঠছে করিডোরের ভেতরেই 'উন্নয়ন'।

‎এদিকে, গারো, হাজং, কোচসহ পাহাড়ে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠী বছরের পর বছর ধরে একই জায়গায় বসবাস করেও ভূমির মালিকানা পায় না। প্রশাসনের কাগজে তারা আজও ‘অবৈধ দখলদার’—যার ফলে তারা উচ্ছেদযোগ্য, অধিকারহীন, এবং চুপ থাকাই শর্ত।

‎অনেকেই ভাবেন, হাতি হঠাৎ পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—বন্য হাতির চলার নির্দিষ্ট করিডোর ছিল। সেই করিডোরের ভেতর দিয়ে তারা যুগ যুগ ধরে চলেছে—বাংলাদেশ থেকে ভারতে, আবার ভারতে থেকে বাংলাদেশে। কিন্তু এই করিডোর এখন বন্ধ। কেন?

‎পাহাড় কেটে বানানো রিসোর্ট, পিকনিক স্পট, ‎করিডোরের ভেতরে মৎস্য প্রকল্প,
‎বনাঞ্চলে রাবার বাগান

‎এসবের মালিক কারা? উত্তর সহজ নয়। কেউ রাজনৈতিক নেতা, কেউ বন বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা, কেউ ঢাকার বড় ব্যবসায়ী। রাষ্ট্র নিজেই আজ হাতির পথ দখল করেছে।
‎ফলে হাতি বাধ্য হয়ে লোকালয়ে আসে, খাদ্য খোঁজে। আর তা-ই হয় পাহাড়িদের জন্য মৃত্যুর কারণ।

‎সংবিধানে নেই পাহাড়িদের নিরাপত্তা?

‎এদেশের সংবিধানে সমানাধিকার সবার। কিন্তু পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসীদের এই অধিকারের কোনো প্রয়োগ নেই।তারা জমির মালিকানা পায় না।পায় না ব্যাংক লোন।
‎প্রশাসন তাদের “অবৈধ দখলদার” বলে চিহ্নিত করে।ভোটের সময় ছাড়া কেউ তাদের খোঁজ রাখে না।মৃত্যুর খবর ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছায় না।

‎যেমন, ঝিনাইগাতীর গজনী এলাকার এক বৃদ্ধ হাজং মহিলা বলেন: “আমার স্বামী আর ছেলে দুজনেই এক রাতে হাতির পায়ে মরেছে। কেউ একটা মানুষ এসে জিজ্ঞেস করেনি—তুমি কেমন আছো?”

‎রাষ্ট্র কি কেবল হাতির পক্ষে?

‎বাংলাদেশে বন্য হাতি ‘সংরক্ষিত প্রাণী’। একে হত্যা করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হয়।
‎এই আইন অবশ্যই জরুরি, কিন্তু প্রশ্ন হলো—মানুষের প্রাণ রক্ষা করার জন্য কি কোনো জরুরি ব্যবস্থা আছে? না।

‎একটা মানুষ যদি হাতিকে রুখতে গিয়ে বাঁশ দিয়ে ধাক্কা দেয়, তাকেও মামলা খেতে হয়। অথচ মানুষ মরলে শুধু একটি “আবেদন” জমা দেওয়ার সুযোগ পায়।

সরকারের ভূমিকা

‎প্রশাসনের ভাষায়, হাতি তাড়াতে ,কমিউনিটি অ্যালার্ট, লোকাল টিম, টিন পেটানো দঙ্গল, দূরবীন তদারকি, ফেন্সিং - সব আছে। কিন্তু বাস্তবে কী আছে?
‎বাস্তবে আছে - কোনো বাজেট নেই, প্রশিক্ষণ নেই, প্রযুক্তি নেই।
‎শুধু আছে স্থানীয় কৃষকের আত্মরক্ষা।

‎এমনকি হাতির গতি পর্যবেক্ষণ বা হুমকি শনাক্ত করার জন্য কোনো স্থায়ী ক্যামেরা, সোলার ফেন্স, এলার্ট ডিভাইস কিছুই নেই। অথচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, কেরালায় এসবই আজ বাস্তবতা।

‎সমাধানের পথ কোথায়?

‎বাংলাদেশে হাতি-মানব সংঘাত প্রতিরোধে কোনও টেকসই জাতীয় নীতিমালা নেই। এলাকা ভিত্তিক ক্ষুদ্র প্রকল্প হয়েছে, যেগুলো মাঠপর্যায়ে অনেক সময় ফলপ্রসূ নয়।

‎নিরাপদ করিডোর তৈরি, ইলেকট্রিক ফেন্সিং, আধুনিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, জরুরি ত্রাণ ফান্ড, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং ভূমি মালিকানা দেওয়া—এইসব চর্চা বাস্তবায়ন ছাড়া পাহাড়ে শান্তি ফিরবে না। উন্নয়নের নামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ নয়, চাই অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা। বন ও প্রাণী সংরক্ষণ মানে শুধু গাছ লাগানো নয়—মানুষ বাঁচানোও এর অংশ।

‎রাষ্ট্রের প্রতি শেরপুরের পাহারীদের দাবি,
‎১.হাতির করিডোর পুনঃস্থাপন
‎২.পাহাড়িদের পূর্ণ ভূমির মালিকানা প্রদান
‎৩. ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জরুরি রেসপন্স ইউনিট
‎৪.প্রযুক্তি নির্ভর অ্যালার্ট ব্যবস্থা
‎৫.ক্ষতিপূরণ প্রকল্প সহজীকরণ ও ত্বরান্বিতকরণ
‎৬.গণমাধ্যমে নিয়মিত এই সংকটের প্রচার
‎৭.পাহাড়ি জনজীবনকে উন্নয়নকেন্দ্রিক জাতীয় পরিকল্পনায় যুক্তকরণ

‎শেরপুরের পাহাড়ে এখনো প্রতিদিন মানুষ ঘুমাতে যায় এই ভাবনায়—আজ কি মরবো, না কাল?
‎এই ভয় কোনো প্রাকৃতিক নয়, এটি রাষ্ট্র-সৃষ্ট। উন্নয়ন ব্যবস্থার ভুল, বননীতির অপব্যবহার, পাহাড়িদের নাগরিকতা অস্বীকার, আর হাতির নিরাপত্তাকে মানুষের জীবনের ওপরে রাখার কারণে আজ এই ভয়।
‎আমরা হাতিকে রক্ষা করবো, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু মানুষকে উপেক্ষা করে নয়।
‎কারণ, এই পাহাড়েও মানুষ বাস করে—তারা নাগরিক, তারা ভোট দেয়, তারা ট্যাক্স দেয়। কিন্তু তারা মরলে রাষ্ট্র শুধু নীরব দর্শক।

শিহাব

×