
ছবি: জনকণ্ঠ
সুখের ছায়ায় স্বপ্ন বুনছে লিপি ও শাহানারা, বাড়ছে শিক্ষারহার, মেয়েরা মুক্তি পাচ্ছে বাল্য বিয়ে থেকে।
ব্রক্ষপুত্র নদের পারে চিলমারী উপজেলা। এই উপজেলার মানুষ নদীভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। একসময়কার বড় গৃহস্থ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সব হারিয়ে হয়ে যায় শ্রমজীবী মানুষ। দুর্গম এ এলাকার মানুষ নানা অনিশ্চয়তার মাঝে তাদের সন্তানদের লালন পালন করে। বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। বাল্য বিয়ে এখনও হয় অনেক বেশি। দুর্গম চরাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রাইমারি পাশ করার পর মেয়ে শিশুদের বাড়িতেই থাকতে হয়। এক অনিশ্চয়তার মাঝে কাটে তাদের জীবন। এমতাবস্থায় তাদের বিয়ে দিয়ে দেয় অভিভাবকরা।
কিন্তু সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার মায়েরা তাদের কন্যা সন্তানদের সময় উপযোগী করে বাল্য বিয়ে দিতে বাধা দিচ্ছে। এ কারণে ঐসব এলাকায় বেড়েছে মেয়ে শিশুর শিক্ষার হার। মেয়েরা মুক্তি পাচ্ছে বাল্য বিয়ে থেকে। এমনই এক মা চিলমারীর রাজার ভিটার গ্রামের ব্রক্ষপুত্র নদের পারের গৃহবধূ লিপি বেগম। শুধু বাড়ি ভিটাটি ছাড়া আর কিছু নেই। এক বছর আগে স্বামীর মৃত্যু হয়। তিন সন্তানকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে লিপি বেগম। সংসারে উপার্জন করার কেউ না থাকায় বড় মেয়ে আখিতারার বিয়ের বয়স না হলেও গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনদের চাপে মেয়ের বিয়ে দেয়ার সিন্ধান্ত নেন। কিন্তু বাধা দেয় স্থানীয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন মাঠ কর্মী। লিপি বেগমকে বাল্য বিয়ের কুফল জানায়। তারা সহায়তা করে ১৭ হাজার টাকা দিয়ে। তাই দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনে শুরু করেন দর্জির কাজ। তাকে ঐ সংস্থা প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে। লিপি বেগম সন্তানদের পড়াশোনা করার অঙ্গীকার করেন। সরে আসেন সন্তানের বাল্য বিয়ে থেকে। প্রতিদিন সেলাই মেশিন দিয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে কোন রকমে চলে তার জীবন আর সন্তানদের পড়াশুনা। পরে সে ছাগল পালন শুরু করে। এতে দ্রুত সংসারের উন্নতি হতে থাকে। একদিকে বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ ও অন্যদিকে ছাগল এবং হাঁস-মুরগি পালনে আলোর মুখ দেখে লিপি বেগম। এক বছরের মধ্যে সংসারের অভাব অনটন দূর হতে শুরু করে। লিপি বেগম শান্তির ছায়ার এখন সুখের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে।
তিনি জানান, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে পড়াশুনা করাবেন। তারা যতদূর পড়াশোনা করতে চায়। তারা যেন দেশের মানুষের উপকার করতে পারে। এ স্বপ্ন দেখেন।
শুধু সে নয়, রমনা খামার এলাকার শাহানা বেগমের চার সন্তান নিয়ে অভাবী সংসার। সংসারে টানাটানির কারণে অল্প বয়সেই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এবং তৃতীয় মেয়ে মুক্তা ৬ষ্ট শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ের সিন্ধান্ত নেন। পরে বাল্য বিয়ের কুফল জানতে পারেন এবং তাদের দেয়া ১৭ হাজার টাকা ও পরামর্শে ছাগল পালন ও সবজি চাষ শুরু করেন এবং সফলতার মুখ দেখেন। ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে স্বামীকে নৌকাও কিনে দেন। মেয়ে মুক্তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এখন মুক্তা পড়াশোনা করছে। আর শাহানা বেগমের সংসারে সুখের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
একই উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের সরদার পাড়া গ্রামের বিধবা খাদেজা বেগম। স্বামী মারা যাবার পর গ্রামবাসীর সহায়তায় বাড়িতেই কাপড়ের ব্যবসার সাথে সেলাইয়ের কাজ শুরু করে। বর্তমানে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করেন। গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনের চাপেও মেয়েকে বাল্য বিয়ে থেকে বিরত রেখে পড়াশোনা চালাচ্ছেন। তিনি তাকে উচ্চ শিক্ষিত করে শিক্ষক বানাতে চান। এমনিতেই চর এলাকায় শিক্ষিত মানুষের খুব অভাব। এখানকার শিশুরা অযত্নে অবহেলায় বড় হচ্ছে। তাই তার প্রত্যাশা তার সন্তান শিক্ষিত হয়ে এসব অবহেলিত শিশুদের পাশে যেন থাকে।
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান আর ডি আর এস এর চাইন্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ১৬২টি পরিবারকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে এবং এসব পরিবারের মেয়েদের বাল্য বিয়ে বন্ধ করেছে। এই প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা বাল্য বিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ উপজেলা। এখানে বাল্য বিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ নদী ভাঙন ও দারিদ্রতা। লিপি, শাহানাদের মতো হাজারো পরিবারে বাল্য বিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশু রয়েছে। তাদের স্বাবলম্বী করতে সিএনবি প্রকল্পের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি মূলক প্রশিক্ষণের পর আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। এর প্রথম ও প্রধান শর্ত ছিল পরিবারগুলো যেন মেয়ে শিশুর পড়াশোনা চালিয়ে নেন এবং বাল্য বিয়ে না দেয়।
আবির