
ছবিঃ সংগৃহীত
বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নচিত্র বিশ্লেষণ করলে এক কথায় বলা চলে—যে দেশের তরুণ প্রজন্ম যত বেশি দক্ষ, সচেতন ও মানবিক, সে দেশ ততই উন্নতির শিখরে পৌঁছায়। আমাদের দেশেও তরুণদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই তরুণরাই সমাজের সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই তারুণ্য কীভাবে সমাজ উন্নয়নে অংশ নিচ্ছে, এবং সামাজিক সংগঠনগুলো সেই পথ কতটা সুগম করছে?
একবিংশ শতাব্দীর এই তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর যুগে তরুণরা হয়ে উঠছে নতুন সম্ভাবনার দূত। তারা শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এর অন্যতম মাধ্যম—সামাজিক সংগঠন।
আজকের তরুণ সমাজ আর শুধু চাকরি পাওয়ার আশায় মুখিয়ে থাকা এক প্রজন্ম নয়। তারা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা—যেমন বাল্যবিয়ে, যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন, কিশোর অপরাধ, বিচারহীনতা, বৈষম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো সমাজ উন্নয়নের ফ্রন্টলাইনে দাঁড়িয়ে কাজ করছে। তারা রক্তদান কর্মসূচি, পথশিশুদের সহায়তা, অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সহায়তা, কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া তরুণরা জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ত্রাণ বিতরণ, সচেতনতা মূলক সভা-সেমিনার, মানববন্ধন এবং পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত হয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।
তবে এই সম্ভাবনার ভেতরেই লুকিয়ে আছে কিছু আশঙ্কার চিত্র। আজ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠছে অসংখ্য সামাজিক সংগঠন—কিন্তু এর বড় একটি অংশ কেবল কাগজে-কলমে। সংগঠনের সভাপতি, সম্পাদক পদের নামে চলছে সামাজিক স্বীকৃতির প্রতিযোগিতা। দেখা যায়, সংগঠন তৈরি করেই অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। অনেকে আবার রাজনৈতিক পরিচয়ের বলয়ে পড়ে এগুলোকে ‘সামাজিক’ সংগঠন থেকে ‘রাজনৈতিক’ সংগঠনে রূপান্তর করে ফেলছেন।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিচালিত সংগঠনগুলোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন প্রায়শই হয় না। সমাজসেবার বদলে আত্মপ্রচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে প্রকৃত সমাজ উন্নয়ন ব্যাহত হয়। এসব কারণে সামাজিক সংগঠনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কিছুটা কমে যাচ্ছে।
সব প্রতিকূলতার মাঝেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু তরুণ নিঃস্বার্থভাবে সমাজের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তারা দলবদ্ধভাবে পথশিশুদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, অসহায় শিক্ষার্থীদের সহায়তা করছেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা উপকরণ দিচ্ছেন। তারা স্বেচ্ছায় বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে এগিয়ে আসছেন উদ্ধার কাজে ও আর্থিক সহায়তা প্রদানে।
এই তরুণরাই আজকের সমাজের দীপ্তিমান সূর্য। তারা নিজেদের চিন্তা-চেতনায় পুরাতন সমাজব্যবস্থার সংস্কার ঘটিয়ে নতুন কিছু গড়ার সাহস দেখাচ্ছেন।
প্রকৃত সামাজিক পরিবর্তন আনতে হলে তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত সামাজিক সংগঠনগুলোকে হতে হবে সৎ, স্বচ্ছ, উদ্দেশ্যপ্রবণ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাসম্পন্ন। নেতৃত্বে থাকা তরুণদের হতে হবে আদর্শবাদী, পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল এবং সাহসী। তাদের কাজ হতে হবে কাজের জন্য, পদ-পদবির জন্য নয়।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তরুণদের সামাজিক সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে। সামাজিক সংগঠনগুলোর রেজিস্ট্রেশন, প্রকল্প নিরীক্ষা ও কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য একটি স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামো থাকা জরুরি।
একটি সমাজ যত বেশি নৈতিক, মানবিক এবং উদ্যমী তরুণদের দ্বারা পরিচালিত হবে—তা তত দ্রুত এগিয়ে যাবে। তরুণরাই পারে পুরাতন সমাজের অব্যবস্থাপনা ভেঙে নতুন এক উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে উচ্চারণ করেছেন—
“আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত, গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত”,
তেমনি প্রতিটি তরুণকেই আজ সমাজ পরিবর্তনের গান গাইতে হবে, রচতে হবে উন্নয়নের নতুন কাব্য।
আলীম