
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের পূর্ব দিকে অবস্থিত ছোট্ট শান্ত গ্রাম মিসকিনিপাড়া—যা স্থানীয়ভাবে ‘রাখাইন পল্লি’ নামে পরিচিত। এখানেই অবস্থিত উপকূলীয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক বৌদ্ধ মন্দির, যা কেবল একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং রাখাইন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের এক অনন্য প্রতীক।
মন্দিরটির ইতিহাস জড়িয়ে আছে ১৭৮৪ সালের একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে। সে বছর বার্মার রাজা বোদপায়া আরাকান রাজ্য দখল করলে বহু রাখাইন পরিবার দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে, বিশেষত কুয়াকাটায় গড়ে ওঠে রাখাইনদের নতুন আবাস। এই ‘কুয়াকাটা’ নামটিও এসেছে তাদের কূপ খননের ইতিহাস থেকে।
প্রাথমিকভাবে কাঠের তৈরি একটি সাধারণ উপাসনালয় হিসেবেই মন্দিরটির সূচনা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি রূপ নেয় একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। স্থানীয় দানশীল পরিবার ও বিদেশি পর্যটকদের সহায়তায় মন্দিরটির সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধন ঘটে।
এই বৌদ্ধ মন্দিরটি শুধু রাখাইন সম্প্রদায়ের নয়, বরং পুরো এলাকার জন্যই একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। প্রতি বছর এখানে পালন করা হয় গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসব, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: বুদ্ধ পূর্ণিমা, কথিন চীবর দান, ওয়া (বৃষ্টিকালীন) প্রার্থনা। মন্দিরের চারপাশে গড়ে উঠেছে এক সহনশীল ধর্মীয় পরিবেশ, যেখানে মুসলিম, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বসবাস করছেন।
মন্দিরটির স্থাপত্যশৈলীতে বার্মিজ প্রভাব স্পষ্ট। চোখে পড়ে রঙিন অলংকরণ, স্বর্ণালি বুদ্ধ মূর্তি এবং ছাদের তীরাকৃতির নকশা—যা একে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করে। মন্দির চত্বরে রয়েছে ধ্যানস্থ বুদ্ধের একাধিক প্রতিমূর্তি ও ধর্মীয় চিত্রকর্ম, যা দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে।
কুয়াকাটা ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এই মন্দির। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা নিয়মিতই ঘুরে যান এই প্রাচীন ধর্মীয় স্থানটিতে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা ও সংরক্ষণের অভাবে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে বসেছে।
তাদের দাবি, এই মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হলে কেবল ধর্মীয় ঐতিহ্যই নয়, স্থানীয় অর্থনীতিও লাভবান হবে।
রাখাইন পল্লির এই প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির কেবল অতীতের স্মারক নয়, বরং ধর্মীয় সহনশীলতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও মানবিক ঐক্যের এক জীবন্ত নিদর্শন—যা যত্ন ও সংরক্ষণের যোগ্য।
ফরিদ