ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৪ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফুটপাত দখল ও অপরিকল্পিত বহুতল ভবন নির্মাণে যানজটের সৃষ্টি

সোহেল রানা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পাবনা সদর:

প্রকাশিত: ০১:১৫, ৩ জুন ২০২৫

ফুটপাত দখল ও অপরিকল্পিত বহুতল ভবন নির্মাণে যানজটের সৃষ্টি

নদী, খাল, বিল, হাওর, শিক্ষা ও শিল্পনগরী—ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জেলা পাবনা। জেলা শহর হলেও এই শহরে মানুষের বসবাস অনেক বেশি। প্রতিদিন ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। শহরের প্রধান সড়ক আব্দুল হামিদ রোডে প্রায় সারাদিনই যানজট লেগে থাকে। এতে মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, জরুরি প্রয়োজনে সমাধান মিলছে না। অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের প্রয়োজন হলেও অন্য গাড়িগুলো সাইড দিতে না পারায় অনেক সময় চরম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়।

পাবনা সদর পৌরসভায় বর্তমানে প্রায় ২,২০,০৮৮ জন মানুষ বসবাস করেন। আর পুরো পাবনা জেলার জনসংখ্যা প্রায় ২১,৭৬,২৭০ জন। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ প্রতিনিয়ত জেলা শহরের সাথে সরাসরি জড়িত।

এই যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো—অপরিকল্পিতভাবে রাস্তার উভয় পাশে গড়ে ওঠা বহুতল মার্কেট ও ভবন। শহরের অধিকাংশ বড় মার্কেটে নেই নিজস্ব গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। ফলে রাস্তার পাশে যেখানে-সেখানে যানবাহন পার্কিং করে রাখা হয়, যা যানজট সৃষ্টি করছে।

শহরের আশেপাশে রয়েছে স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো—সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ, পাবনা কলেজ, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, জেলা স্কুল, আরএম একাডেমি স্কুল, সেলিম নাজির উচ্চ বিদ্যালয়, কালেক্টরেট মডেল স্কুল, পাবলিক কালেক্টরেট স্কুল, পুলিশ লাইন্স স্কুল, সেন্ট্রাল গার্লস হাই স্কুল, টাউন গার্লস হাই স্কুলসহ আরও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও আদালত।

এছাড়াও শহরের কাছেই অবস্থিত পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা মেডিকেল কলেজ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয় জেলা শহরের মধ্য দিয়ে। ফলে সংকীর্ণ রাস্তায় অতিরিক্ত অটো রিকশা ও মিশুক চলাচলের ফলে যানজট অনিবার্য হয়ে পড়ছে।

বিশেষ করে, যেসব বড় মার্কেটে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই, সেখানে যততত্র গাড়ি রেখে যানজট আরও প্রকট করে তুলছে। সচেতন নাগরিকদের মতে, এসব অবকাঠামো নির্মাণের সময় পার্কিং ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক করা উচিত ছিল।

শহরের পরিবেশ ও সামাজিক সংগঠকরা বলছেন, ধরুন একটি বহুতল মার্কেটে ১০০টি দোকান রয়েছে। দোকান মালিক ১০০ জন, কর্মচারী আরও ১০০ জন। অধিকাংশের কাছে নিজস্ব মোটরবাইক রয়েছে। ফলে প্রায় ২০০টি বাইক প্রতিদিন সেখানে আসে। অথচ মার্কেটে সেই বাইক রাখার মতো ব্যবস্থা নেই। তাই তারা যেখানে-সেখানে বাইক পার্কিং করছেন, যা যানজট বাড়িয়ে দিচ্ছে।

শহরের থানা মোড় থেকে তাড়াশ ভবন পর্যন্ত (রায় বাহাদুর গেট) যানজট লেগেই থাকে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির সময় ট্রাফিক পুলিশদের হিমশিম খেতে হয়।

ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আযহা, দুর্গাপূজার মতো বড় ধর্মীয় উৎসবগুলোতে যানজট ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

অটো চালকদের মধ্যে প্রশিক্ষণের অভাবও এই সমস্যাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মত দিয়েছেন সচেতন মহল।

শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সংগঠক ও সাংবাদিক জুবায়ের খান প্রিন্স বলেন, “ফুটপাত দখল, চালকদের আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব, অনিয়ন্ত্রিত ওভারটেকিং, স্বেচ্ছাচারিতায় গাড়ি পার্কিং ও যেখানে-সেখানে ইউটার্ন নেওয়াই যানজটের মূল কারণ।”

যানজট নিরসনে জেলা পুলিশ এবং পৌরসভার ট্রাফিক বিভাগ সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) পাবনা জেলা শাখার সভাপতি খন্দকার গোলাম হাসনাইন কোয়েল বলেন, “ফুটপাত দখল ও অপরিকল্পিত বহুতল ভবন নির্মাণই যানজটের প্রধান কারণ। প্রতিটি মার্কেটে নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা নিশ্চিত না করলে এই অবস্থা চলতেই থাকবে। পৌরসভা যখন বহুতল ভবনের অনুমোদন দেয়, তখনই যদি বিল্ডিং প্ল্যানে পার্কিং স্পেস বাধ্যতামূলক করা হতো, তাহলে এ সমস্যা হতো না।”

তিনি আরও জানান, “আমরা অটো ও রিকশা চালকদের ট্রাফিক সচেতনতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। পিটিআই-এর মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছি যেন তারা শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পারেন।”

এদিকে, যানজট নিরসনে শহরে ফুটপাত দখলদারদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান চলছে।

উল্লেখ্য, পাবনা বাস টার্মিনাল থেকে শহরের আব্দুল হামিদ রোড হয়ে গাছপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও সচেতন মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহলে পাবনাবাসী পাবে একটি যানজটমুক্ত আধুনিক শহর।

ফরিদ

×