ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৪ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার সুন্দরবনের অস্থিত্বকে ‘চ্যালেঞ্জ’ জানাচ্ছে

এম জুবায়ের মাহমুদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা।

প্রকাশিত: ১০:০৮, ২ জুন ২০২৫

প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার সুন্দরবনের অস্থিত্বকে ‘চ্যালেঞ্জ’ জানাচ্ছে

ছবি: জনকণ্ঠ

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে গেল কয়েক বছর ধরে নানামুখী প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তীরবর্তী অংশে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ব্যাপক নির্ভরশীলতার পাশাপাশি রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধির মতো ক্ষতিকর প্রভাব। এছাড়া সুন্দরবনকে আবর্তিত করে ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস এখন নিত্যকার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

তবে এতসব শত্রুর মোকাবিলা করে টিকে থাকা এ বনাঞ্চলের উপর মনুষ্যসৃষ্ট নতুন প্লাস্টিক-পলিথিন ব্যবহার যোগ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অপচনশীল বস্তু হিসেবে প্লাস্টিক-পলিথিন সুন্দরবনের প্রাণীকুল ও প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতি করে চলেছে। যা পরোক্ষভাবে মানবদেহের জন্যও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে যাচ্ছে। এছাড়া নতুন নতুন গাছ-গাছালি বিস্তারের ক্ষেত্রেও তা খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এলাকার অসচেতন লোকজনের কারণে সুন্দরবনের বৈচিত্র্যকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।

সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সুন্দরবনে প্রতি লিটার পানিতে অন্তত দু’টি এবং প্রতি কেজি মাটিতে প্রায় সাড়ে সাত শতাধিক মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। এছাড়া সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন নদ-নদী এবং খাল হতে শিকারকৃত প্রতি কেজি মাছ গড়ে ১০–১৫ মিলিগ্রাম মাইক্রোপ্লাস্টিক বহন করছে। ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি থাকার পাশাপাশি কিডনি ও লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে সক্ষম উক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশসহ উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুলেরও মারাত্মক ক্ষতি করছে।

পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন কদমতলা, হরিনগর, নীলডুমুর ও কৈখালী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাশের নদীসমূহে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক-পলিথিন ভেসে বেড়াচ্ছে। খাবারের কাজে ব্যবহৃত প্লেটের (একবার ব্যবহারযোগ্য) পাশাপাশি ভাসমান সেসব প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে কোমল পানীয়সহ খাবার পানির বোতল। এছাড়া চানাচুর, চিপস, বিস্কুটসহ নানা প্রকার খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট ছাড়াও উপকরণাদি বহনের কাজে ব্যবহৃত পলিথিন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে প্লাস্টিকের একবার ব্যবহারযোগ্য প্লেট ও গ্লাস ব্যবহারের জনপ্রিয়তা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পারিবারিক সকল অনুষ্ঠানের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারসমূহে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন। ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত সেসব প্লাস্টিক-পলিথিন ধ্বংস না করে বরং নানাভাবে তা পাশের নদী ও খালে ফেলা হচ্ছে।

পরক্ষণে জোয়ার-ভাটার সুযোগে সেসব পরিত্যক্ত বস্তুসমূহ সুন্দরবনসহ আশপাশের নদ-নদীতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন নদ-নদী মারাত্মকভাবে দূষণের শিকার হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়ছে স্থানীয় জীব ও প্রাণবৈচিত্র্য। শিকার করা মাছের পেটে প্লাস্টিক-পলিথিনের অস্তিত্ব পাওয়ার দাবি করে স্থানীয়রা জানান, পলিথিনে আটকে মাছ ও কচ্ছপের মৃত্যুর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তারা। এছাড়া অপচনশীল এসব বর্জ্যের আধিক্যে সুন্দরবনের চর ও ফাঁকা জায়গায় গাছের বিস্তৃতি ভয়ংকরভাবে হ্রাস পেয়েছে।

প্লাস্টিক-পলিথিনের মারাত্মক উপস্থিতি সেখানকার প্রাণীকুলের জন্য নানাভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তিনি জানান, আরও বেশি ক্ষতি হওয়ার আগেই সুন্দরবনের নদ-নদীসমূহকে প্লাস্টিক-পলিথিনের দূষণমুক্ত করা দরকার। সেজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ আইনের কঠোর প্রয়োগ খুবই জরুরি।

সুন্দরবনের দূষণ নিয়ে কাজ করা ইয়ুথ নেট গ্লোবাল-এর সাতক্ষীরা জেলা সাবেক সমন্বয়কারী এস এম শাহিন বিল্লাহ বলেন, প্লাস্টিক-পলিথিনে সুন্দরবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকসহ পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার সুন্দরবনের অস্থিত্বকে রীতিমতো ‘চ্যালেঞ্জ’ জানাচ্ছে। উপকূলের সুরক্ষা ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করা এ তরুণের দাবি, সুন্দরবনের নদ-নদীতে থাকা প্লাস্টিক-পলিথিনের কারণে মাছসহ উদ্ভিদের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি বৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবন তার অনুকূল পরিবেশ হারাচ্ছে।

সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জার হাবিবুর রহমান জানান, সুন্দরবনে আগত পর্যটকদের প্লাস্টিক-পলিথিন ব্যবহারে সতর্ক করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পর্যটকবাহী কয়েকটি নৌযানকে জরিমানা করা হয়েছে। তবে, বেশিরভাগ প্লাস্টিক-পলিথিন উপকূলবর্তী বাজারগুলোসহ সেসব এলাকায় বসবাসরত পরিবারগুলোর মাধ্যমে সুন্দরবনের নদ-নদীতে ছড়াচ্ছে বলে দাবি তার।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ রনী খাতুন জানান, সুন্দরবনের দূষণমুক্ত রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে। যত্রতত্র প্লাস্টিক-পলিথিন না ফেলতে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। বিভিন্ন অংশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে স্থানীয়দের উৎসাহিত করা হচ্ছে। উপকূলবাসীকে মায়ের মতো আগলে রাখা সুন্দরবনকে রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়দের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

মুমু

×