ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আফ্রিকা দরিদ্র নয়, তাকে দরিদ্র করে রাখা হয়েছে!

মুহাম্মদ ওমর ফারুক

প্রকাশিত: ০১:২৫, ৪ জুন ২০২৫

আফ্রিকা দরিদ্র নয়, তাকে দরিদ্র করে রাখা হয়েছে!

ছবি: সংগৃহীত

প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও আফ্রিকা বিশ্বের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর অন্যতম। অথচ আফ্রিকার মাটির নিচে রয়েছে সোনা, হীরা, তেল, কোলটান, কপারসহ অগণিত মূল্যবান খনিজ সম্পদ। প্রশ্ন উঠছে—আফ্রিকা কি প্রকৃত অর্থে দরিদ্র, নাকি পরিকল্পিতভাবে তাকে দরিদ্র করে রাখা হয়েছে?

বিশ্লেষকরা বলছেন, আফ্রিকার দারিদ্র্য কোনো দৈব ঘটনা নয়। এটি উপনিবেশিক শোষণ, বৈশ্বিক কর্পোরেট লুটপাট, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং পশ্চিমা অর্থনৈতিক প্রভাবের এক সুপরিকল্পিত ফলাফল।

আফ্রিকার অর্থনৈতিক দুর্দশার সূচনা হয় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। ১৯ শতকে ‘Scramble for Africa’ নামে পরিচিত এক প্রতিযোগিতায় ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ ইউরোপীয় শক্তিগুলো আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয়। এই সময়কালে আফ্রিকার সম্পদ এবং শ্রমকে শোষণ করা হয় ইউরোপের উন্নয়নের জন্য।

বিশেষজ্ঞ ড. কামাউ আদেকানলে বলেন, “উপনিবেশের সময় আফ্রিকাকে শুধু সম্পদের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, বিনিময়ে তারা কিছুই পায়নি—না অবকাঠামো, না শিক্ষা, না স্বাধীন অর্থনীতি।”

১৯৬০-এর দশকে আফ্রিকার অনেক দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি মেলেনি। ফরাসি ও ব্রিটিশ প্রভাব আজও বহু দেশে কার্যত সক্রিয়। ফ্রান্স, উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশের রিজার্ভ মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ফরাসি ট্রেজারির মাধ্যমে।

সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আফ্রিকার ১৪টি দেশ এখনো ফরাসি নিয়ন্ত্রিত CFA ফ্রাঙ্ক ব্যবহার করে, যার বিনিময় হার ও মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রান্স।

আফ্রিকার খনিজ ও তেল-গ্যাস খাত প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি। তারা স্থানীয় সরকারের দুর্নীতিকে কাজে লাগিয়ে কম দামে খনিজ উত্তোলনের চুক্তি করে, অথচ লাভের বড় অংশ যায় বিদেশে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কঙ্গোতে কোলটান খনির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পশ্চিমা প্রযুক্তি কোম্পানিরা, যেগুলো মোবাইল ও কম্পিউটার উৎপাদনের জন্য এই খনিজ ব্যবহার করে। অথচ কঙ্গোর স্থানীয় জনগণ পাচ্ছে অনাহার, সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও বিশ্বব্যাংকসহ পশ্চিমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আফ্রিকার দেশগুলোকে 'উন্নয়নের নামে' ঋণ দিয়েছে, যার ফলে তারা আজ ঋণের ফাঁদে বন্দি। শর্ত সাপেক্ষে দেয়া এই ঋণের মাধ্যমে আফ্রিকার অর্থনীতি কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে বাইরের শক্তি।

বিশ্লেষকরা বলেন, এই তথাকথিত “উন্নয়ন সহযোগিতা” আসলে আফ্রিকাকে আত্মনির্ভর হতে না দিয়ে নির্ভরশীল করে রেখেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আফ্রিকাকে তার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বহির্বিশ্বের চাপের বাইরে গিয়ে স্বাধীন অর্থনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

ড. আদেকানলে বলেন, “আফ্রিকা দরিদ্র নয়। আফ্রিকাকে দরিদ্র বানানো হয়েছে—এখন সময় এসেছে সেই শৃঙ্খল ভাঙার।”

আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ তার দুর্দশার মূল নয়, বরং এসব সম্পদের প্রতি বাইরের আগ্রহ এবং দখলের রাজনীতিই আজ আফ্রিকাকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এই অন্যায়ের ইতিহাসকে স্বীকার করে, আগামী দিনের জন্য ন্যায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়তে না পারলে, আফ্রিকার ‘ধনী ভূমিতে দরিদ্র মানুষ’ গল্পের কোনো অবসান হবে না।

ফারুক

×