ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ধ্বংসের মুখে সারমারা নাছির উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়

বাঁধন মোল্ল্যা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, জামালপুর

প্রকাশিত: ১০:২০, ১ জুন ২০২৫

ধ্বংসের মুখে সারমারা নাছির উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়

ছবি: জনকণ্ঠ

একটি বিদ্যালয় কেবল শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জায়গা নয়, এটি একটি সমাজের বিবেক গঠনের কেন্দ্র, একটি জাতির উন্নয়নের ভিত্তি। তবে সেই ভিত্তি যদি ক্রমাগত দুর্বল হয়, শিক্ষার আলো নিভে যেতে থাকে, তবে শুধু একটি ভবন নয়, ধ্বংস হয়ে যায় একটি ভবিষ্যৎ, একটি সম্ভাবনা, একটি প্রজন্ম। এমনই করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি আজ সারমারা নাছির উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়, যেটি ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে একশত বছরেরও বেশি সময় পার করেছে, কিন্তু আজ যেন সময়ের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে।

জামালপুর বকশীগঞ্জের সারমারা নাছির উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় এক সময় ছিল এ জনপদের গর্ব, শিক্ষার বাতিঘর, আজ তা অনেকের চোখে শুধুই হতাশা ও চরম অব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি। ভেতরের বাস্তবতা এখন আর গোপন নেই, প্রকাশিত হচ্ছে স্থানীয়দের ক্ষোভ, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের হাহাকার এবং অভিভাবকদের উদ্বেগের মাধ্যমে।

পরীক্ষা ফি নয়, যেন ভাগাভাগির উৎসব!

বিদ্যালয়ের পরীক্ষার সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় অতিরিক্ত ফি, যেটিকে বলা হয় “পরীক্ষা পরিচালনার খরচ। অথচ এই অর্থ সংগ্রহের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই, রয়েছে নামে মাত্র রসিদ। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এই অর্থের বণ্টন নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও মাঝে মাঝে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব, ঝগড়া পর্যন্ত হয় কার কত ভাগ। একজন শিক্ষকের নয়, একজন ব্যবসায়ীর মতো অর্থলোভী মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এতে, যা পুরো স্কুলের পরিবেশকেই কলুষিত করে তোলে।

কম্পিউটার ল্যাব থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি!

একসময় বিদ্যালয়ে একটি সমৃদ্ধ কম্পিউটার ল্যাব ছিল, যেখানে ছিল প্রায় ১৫-২০টি মনিটর ও ল্যাপটপ। কিন্তু আজ সেখানে নেই একটি যন্ত্রও। অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষকরা নিজেদের প্রয়োজনে এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে গেছেন বাড়িতে, দিয়েছেন নিজেদের সন্তানদের ব্যবহারের জন্য। কোনো তদন্ত হয়নি, শিক্ষার জায়গায় চলছে চরম অবহেলা ও জবাবদিহীনতা।

শিক্ষার নামে রাজনীতি ও পরিবারতন্ত্রের দৌরাত্ম্য

বিদ্যালয় মানে একটি নিরপেক্ষ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র। অথচ এখানে চলছে অন্তর্দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং, পরিবারতন্ত্র, যা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকেই নষ্ট করে দিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক নিয়োগ, ক্লাস রুটিন, এমনকি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব বণ্টনেও রয়েছে পরিবারভিত্তিক প্রভাব এবং টাকার খেলা। স্থানীয়দের ভাষ্য, বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে রাজনীতি এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে, যোগ্যতা নয়, সম্পর্ক, স্বার্থ আর লেনদেনই এখানে বেশি গুরুত্ব পায়।

নির্বাহী কর্মকর্তার নামের ছায়া, বাস্তব তদারকির অভাব

বর্তমানে, সারা দেশের মতো এই বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটিও বাতিল রয়েছে, এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। তবে বাস্তবতা হলো, তাঁর এই সভাপতিত্ব কেবল নামেই সীমাবদ্ধ। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সংকট, অনিয়ম, এবং দীর্ঘদিনের সমস্যা গুলোতে তাঁর সরাসরি হস্তক্ষেপ বা তদারকির কোনো নজির নেই বললেই চলে। স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা তাই ইউএনও’র সরেজমিন তদন্ত ও হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

এক শতাব্দীর বিদ্যালয়, কিন্তু নেই গর্ব করার কিছু

সারমারা নাছির উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় আজ ১১৪ বছরে পা দিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, এই দীর্ঘ সময়ে বিদ্যালয়টি কখনো একটি পূর্ণাঙ্গ বিদায়ী সংবর্ধনা আয়োজন করতে পারেনি। নেই কোনো বাৎসরিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব, নেই ম্যাগাজিন প্রকাশ, নেই সেরা শিক্ষক বা শিক্ষার্থী মূল্যায়নের উদ্যোগ। এমনকি বিদ্যালয়ের আর্থিক রিপোর্টও অভিভাবক বা শিক্ষার্থীদের সামনে প্রকাশ করা হয় না। এসব যেন প্রমাণ করে বিদ্যালয়টি হারিয়ে ফেলেছে তার দায়িত্ব, আত্মা এবং আদর্শ।

সমাধানের সম্ভাবনা: নতুন আলো জ্বালানোর আহ্বান

দীর্ঘ দিনের জটিলতা, অব্যবস্থা ও অনিয়মের অবসান ঘটাতে এখন প্রয়োজন সাহসী সংস্কার। সে পথে কিছু সুস্পষ্ট পরামর্শ ও দাবি উঠে আসছে, বিদ্যালয় থেকে রাজনীতি ও পরিবারতন্ত্র নির্মূল করতে হবে, গঠন করতে হবে শক্তিশালী ও স্বচ্ছ অ্যালামনাই সংগঠন, চালু করতে হবে নিয়মিত ফান্ড রিপোর্টিং ও দায়িত্ববোধ, শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল আয়োজন, উৎসাহ এবং স্বীকৃতির ব্যবস্থা রাখতে হবে, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত তদারকি ও কার্যকর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

শেষ কথায়: বিদ্যালয় বাঁচাও, ভবিষ্যৎ রক্ষা করো

একটি বিদ্যালয় ধ্বংস মানে একটি জনপদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস। সারমারা নাছির উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের সংকট তাই কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা নয়, এটি একটি অঞ্চলের মনন ও উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবিতে যদি আজই পরিবর্তনের আভাস না আসে, তাহলে আগামী প্রজন্মের সামনে থাকবে না কোনো আলোকিত পথ।

এখন আর সময় নেই শুধু প্রতিবাদের, প্রয়োজন প্রতিকারের, সংস্কারের, পুনর্গঠনের।
সারমারার শিক্ষার্থীরা যেন গর্ব নিয়ে বলতে পারে — “এই বিদ্যালয় আমার, এখানেই আমি মানুষ হয়ে উঠেছি।”

মুমু

×