
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি ঢাকা এখন একটি অদৃশ্য কিন্তু মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় এক কোটি মানুষ ঢাকার কলের পানি পান করে থাকেন, কিন্তু সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই অভ্যাস হয়তো ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলমগীর কবীরের তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অ্যাটমিক এনার্জি সেন্টারের সহায়তায় তাসরিফ নূর আরিয়ান পরিচালিত একটি গবেষণা এই ভয়াবহ বাস্তবতা উন্মোচন করেছে। ‘জার্নাল অব হ্যাজার্ডাস ম্যাটেরিয়ালস’-এ প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার কলের পানিতে এমন সব ভারী ধাতু, অ্যাসিডিক যৌগ ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপদ সীমা বহুলাংশে অতিক্রম করেছে। এটি কেবল দরিদ্র বা বস্তি এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ধানমণ্ডি, মিরপুর কিংবা কামরাঙ্গীরচর—কোনো এলাকাই এখন আর নিরাপদ নয়।
পানিতে ভারী ধাতু উপস্থিতি তাসরিফের নূর আরিয়ানের দল ঢাকার ৩০টি এলাকার পানির নমুনা বিশ্লেষণ করেছে। এর মধ্যে উত্তরখান, মধ্য বাড্ডা, মাতুয়াইল এবং নাজিরাবাজার উল্লেখযোগ্য। গবেষণার ফলাফল ছিল রীতিমতো ভয়াবহ।
মারাত্মক নিউরোটক্সিন হিসেবে পরিচিত পারদ ৭১% নমুনায় পাওয়া গেছে। উত্তরখানে এর মাত্রা ছিল ১.৯৭ মাইক্রোগ্রাম/লিটার, যা জাতীয় নিরাপদ সীমার প্রায় দ্বিগুণ। মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি ঘটানো লেড এর পরিমাণ মধ্য বাড্ডায় ছিল ৯.৩৪ µg/L এবং মিরপুর-১ এ ৯.২৬ µg/L, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর ১০ µg/L সীমার ঠিক নিচে। মরণব্যাধি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী আর্সেনিক (Arsenic) মাতুয়াইলে পাওয়া গেছে ৪.৬৩ µg/L মাত্রায়—সীমার কাছাকাছি। মাঙ্গানিজ (Manganese) মাতুয়াইলে পাওয়া গেছে ৬৮৭.৯ µg/L, যা নিরাপদ সীমার সাতগুণ।
লোহার (Iron) মাত্রা যদিও সীমার মধ্যে ছিল, তবে মাতুয়াইলে পাওয়া ১,০৫০ µg/L লোহা পাইপ ক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে পরিকাঠামোগত ব্যর্থতার লক্ষণ।
দূষিত পানি ও তার ভায়বহতা
৭১% নমুনায় পানির pH মাত্রা ছিল ৫.০৯–৬.৮১, যা WHO-এর ৬.৫ থেকে ৮.৫ সুপারিশকৃত সীমার নিচে। অ্যাসিডিক পানি শুধু স্বাদে সমস্যা তৈরি করে না, এটি ধাতব পাইপ ক্ষয় করে—ফলে আরও বিষাক্ত পদার্থ পানিতে মিশে যায়। মাতুয়াইলে পানির ধোঁয়াশা মাত্রা (Turbidity) ছিল ১৭.৩৩ NTU, যা নিরাপদ সীমার তিনগুণেরও বেশি। এই ধোঁয়াশা পানিতে জৈব বস্তুর পচন ও জীবাণু দূষণের ইঙ্গিত দেয়। দুই-তৃতীয়াংশ নমুনায় দ্রবীভূত অক্সিজেন (DO) পর্যাপ্ত ছিল না, যা অ্যানারোবিক ব্যাকটেরিয়ার সম্ভাবনার ইঙ্গিত করে। অনেক এলাকায় Total Dissolved Solids (TDS)—যা পানিতে প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান নির্দেশ করে সেটিও অত্যন্ত কম পাওয়া গেছে, যা পানির সামগ্রিক মানের নিম্নতা প্রকাশ করে।
মারাত্মক ঝুঁকি তে গণস্বাস্থ্য এই গবেষণা শুধু দূষণের মাত্রা নির্ণয় করেনি, বরং তার স্বাস্থ্যগত প্রভাবও বিশ্লেষণ করেছে। ফলাফল ছিল চরম উদ্বেগজনক।
শিশুদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তাদের শরীর আকারে ছোট, কিন্তু প্রতি কেজি ওজনের তুলনায় বেশি পানি পান করে। তাই লেড-এর জন্য Hazard Quotient (HQ) ছিল ২.০—মানে নিরাপদ সীমার দ্বিগুণ। আর্সেনিকের ক্ষেত্রে HQ দাঁড়ায় ২০.০৫—যা চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। পারদের HQ ছিল ১.১৫—যা শিশুদের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে হুমকি। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও চিত্র সুখকর নয়। আর্সেনিক ও কোবাল্ট হৃদরোগ এবং কিডনি ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ায়। সবচেয়ে ভয়ের বিষয়, লেডের কারণে মোট ক্যান্সার ঝুঁকি (TCR) ছিল প্রতি ১০০ জনে ২.৪ জন—যা গ্রহণযোগ্য ঝুঁকির চেয়ে ২৪ গুণ বেশি। আর্সেনিকের কারণে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ১ জন ভবিষ্যতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এই বিপর্যয়ের কারণ কী? ঢাকার পানির এই বিপর্যয়ের কারণ অনেকগুলো। প্রথমত, শহরের ৮০% পানি আসে ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে, যেগুলোর অনেকগুলোতেই প্রাকৃতিকভাবেই আর্সেনিক ও অন্যান্য খনিজের মাত্রা বেশি। তবে এই সমস্যা আরও বাড়ায় শিল্প দূষণ। হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচরের মতো এলাকায় কারখানাগুলো অবৈধভাবে অপরিশোধিত বর্জ্য পানিতে ফেলে দেয়। ট্যানারি, প্লাস্টিক ও ওষুধ শিল্প সবচেয়ে বড় অপরাধী। পরিবেশ আইন থাকলেও তার প্রয়োগ কার্যত নেই।
শহরের পুরনো পরিকাঠামোও দায়ী। বহু পুরোনো লিকেজধর্মী ও ক্ষয়প্রাপ্ত পাইপ, যেগুলোর অনেকগুলো খোলা নর্দমার পাশ দিয়ে যায়, এসব থেকে বিষাক্ত পদার্থ পানিতে প্রবেশ করে। এসব পাইপের অধিকাংশ কয়েক দশক ধরে পরিবর্তন করা হয়নি। এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা আরও জটিল করেছে। ঢাকায় এখন অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও দীর্ঘ খরা দেখা দেয়, যা বিশুদ্ধ ভূগর্ভস্থ পানি পুনরুদ্ধারে বাধা সৃষ্টি করে।
দায়ী কে?
ঢাকা ওয়াসা (DWASA) স্বীকার করেছে, শহরের প্রায় ৩০% পানি লিকেজ ও চুরির কারণে অপচয় হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলো দুর্নীতি, জটিলতা ও অর্থসংকটে ভোগে। যেমন, “Sustainable Urban Water Cycles” প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। ঢাকার প্রায় ৪০% মানুষ বস্তিতে থাকে, যেখানে তারা কমিউনিটি ট্যাপ বা ব্যয়বহুল বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরশীল। দুর্ভাগ্যবশত, তারাই বেশি খরচ করেও পান নিরাপদ কম।
সমাধান কী?
নিরাশার মাঝেও বিশ্বে কিছু সফল উদাহরণ রয়েছে যেগুলো থেকে ঢাকা শিক্ষা নিতে পারে। সিঙ্গাপুরের “NEWater” কর্মসূচির মাধ্যমে উন্নত বর্জ্যজল শোধন পদ্ধতিতে নিরাপদ পানি তৈরি করা হয়। ডেনমার্কে সবুজ পরিকাঠামো (যেমন: পানিপার্শ্বীয় সড়ক, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা) ব্যবহার করে পানি সরবরাহের ওপর চাপ কমানো হয়। এমনকি রুয়ান্ডার মতো অল্প সম্পদের দেশেও দূষণকারী শিল্পগুলোকে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং রিয়েল-টাইম পানি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
ঢাকার জন্য সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ
আরিয়ান ও তার গবেষণা দল একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রস্তাব করেছেন:
তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা: অবৈধ কারখানা বন্ধ করা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জরুরি জল পরিশোধন ইউনিট স্থাপন করা।
মাঝারি উদ্যোগ: ক্ষয়প্রাপ্ত পাইপ বদলে বিষমুক্ত বিকল্প বসানো এবং শিল্প বর্জ্য পরিশোধনের জন্য কেন্দ্রীয় সিইটিপি (Centralized Effluent Treatment Plant) নির্মাণ। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: পানি নিরাপত্তা পরিকল্পনার সঙ্গে জলবায়ু সহনশীলতা সংযুক্ত করা। শহরের পরিকল্পনায় পুনর্ভরণ অঞ্চল, সবুজ বেষ্টনী এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যুক্ত করা। সচেতনতামূলক প্রচারণা: স্কুল, মসজিদ এবং স্থানীয় মিডিয়ার মাধ্যমে পানির নিরাপত্তা বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা। ডিজিটাল শাসনব্যবস্থা: ওয়াসার মতো সংস্থায় দুর্নীতি কমাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার। স্থানীয় পর্যবেক্ষক দল গঠন করে লিকেজ ও অবৈধ বর্জ্য নিক্ষেপের তথ্য সরাসরি জানানো।
এখনই সময় পদক্ষেপ নেওয়ার এটি কেবল পানি সংকট নয়। এটি একটি জনস্বাস্থ্য সংকট, একটি পরিবেশগত বিপর্যয় এবং একটি নৈতিক ব্যর্থতা। এখনই ব্যবস্থা না নিলে, শহরের শিশুরা প্রতিদিন বিষ পান করেই বড় হবে এবং ভবিষ্যৎ চরম ঝুঁকিতে পড়বে। পরিষ্কার পানি কোনো বিলাসিতা নয়—এটি একটি মৌলিক অধিকার। ঢাকার নেতৃত্বকে এই গবেষণাটি কেবল একটি একাডেমিক প্রকাশনা হিসেবে নয়, বরং একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
তথ্যসূত্র : “Assessment of Heavy Metal Contamination and Health Risks in Tap Water of Dhaka City, Bangladesh” শীর্ষক গবেষণাপত্রের ‘Journal of Hazardous Materials’ (2025)
আসিফ