ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফারাক্কার শিকার দেশের ৬ কোটি মানুষ

মামুন-অর-রশিদ,স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী

প্রকাশিত: ১৩:৩২, ১৫ মে ২০২৫; আপডেট: ১৩:৫৯, ১৫ মে ২০২৫

ফারাক্কার শিকার দেশের ৬ কোটি মানুষ

ফারাক্কার কারণে রাজশাহীতে পদ্মা নদীর বর্তমান অবস্থা। ছবি : জনকণ্ঠ

ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৬ কোটি মানুষ সেচের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এরমধ্যে উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২ কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আর দেশের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের আরও ৪ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।

আগামীকাল শুক্রবার (১৬ মে) ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। 

নগরের একটি রেস্তোরাঁয় এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির আহ্বায়ক ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। এ সময় ফারাক্কা লং মার্চের অংশগ্রহণকারী মাহমুদ জামাল কাদেরীও উপস্থিত ছিলেন। রাজশাহীতে ফারাক্কা লংমার্চ উদযাপন কমিটির সংবাদ সম্মেলন

মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কার কারণে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রজেক্টে পানি স্বল্পতার কারণে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ প্রদান দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদুপানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। এর ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে আসছে। বরেন্দ্র অঞ্চল বিশেষ করে উচ্চ বরেন্দ্রের একশত ভাগ গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ প্রায় অকার্যকর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত পাম্প অকেজো হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নলকূপের পানি খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

এছাড়া বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। স্বাদু পানির অভাবে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ ষোলো আনা সফল হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফারাক্কা রাতারাতি একটি ইস্যুতে পরিণত হলো। দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হলো একই ইস্যুকে ভিত্তি করে। এদিকে ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে তৎকালীন ভারতীয় শাসকেরা ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পাঁচসালা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ উপযুক্ত পরিমাণ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছিল যা সঠিক ভাবেই কার্যকর ছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী বছরের সবচেয়ে কম প্রবাহের সময়কাল এপ্রিলের শেষ ১০ দিন ফারাক্কার প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশ পাবে ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি।

অপরদিকে ভারত পাবে ২০ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি। কোন কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ কমে এলে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অংশের ৮০ ভাগ অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬০০ কিউসেক পানি পাবে। এটি ছিল চুক্তির গ্যারান্টি ক্লজ।

মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, যতই দিন গড়াচ্ছে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব আমাদের ভাবিয়ে তুলছে, আতঙ্কিত করছে। প্রতি বছরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে বাংলাদেশের গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার একটি নিয়মিত ঘটনা। এর পাশাপাশি গঙ্গা-পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় শতাধিক নদ-নদী ক্রমান্বয়ে মৃত খালের রূপ নিচ্ছে।

ফারাক্কার সরাসরি শিকার রাজশাহীর মানুষ উল্লেখ করে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, বিগত ৪০ বছরের ব্যবধানে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় গঙ্গার আয়তন নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে তলদেশ ক্রমান্বয়ে ভরাট হতে চলেছে। জলজ প্রাণী, বিশেষ করে কয়েক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী অংশের গঙ্গায় (পদ্মা) আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ।

ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের কিছু করণীয়ও তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। বলা হয়, ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি এখনও বলবৎ। চুক্তি অনুযায়ী প্রকৃতই বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে কিনা এবং কতটুকু পানি পাচ্ছে, সেটি জনগণ অবহিত নয়। এখন থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনগণকে তা জানাতে বাধ্য থাকবেন। ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই শক্তিশালী কমিটির দ্বারা এর মূল্যায়ন করতে হবে। নতুন চুক্তির জন্য হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে হোমওয়ার্ক সম্পন্ন পূর্বক পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি। নতুন চুক্তিতে ১৯৭৭ সালের চুক্তির অনুরূপ গ্যারান্টি ক্লজ অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কার সমস্যার সমাধানে করণীয় বিষয়ে দ্রুতই তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার সঙ্গে বসবেন।

সা/ই

×