ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

লোকক্রীড়া কি হারিয়ে যাবে?

খেলায় খেলায় ছন্দ আনন্দ

সুবল বিশ্বাস

প্রকাশিত: ০০:৫২, ১৩ অক্টোবর ২০২৩

খেলায় খেলায় ছন্দ আনন্দ

বিলুপ্তির পথে বাংলা ও বাঙালি লোকসংস্কৃতির অন্যতম অতি সহজসরল এবং আনন্দদায়ক শিশুতোষ খেলা কানামাছি

আকাশ সংস্কৃতির বিনোদন এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রচার-প্রসারের দাপটে আজ বিলুপ্তির পথে বাংলা ও বাঙালি লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ সব ধরনের লোকক্রীড়া। অঞ্চল ভেদে গ্রামবাংলার এই লোকক্রীড়াকে লৌকিক খেলা নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। বিলুপ্ত প্রায় লোকক্রীড়ার মধ্যে অতি সহজ ও সরল এবং আনন্দদায়ক শিশুতোষ খেলার মধ্যে কানামাছি অন্যতম। 
বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা লোকক্রীড়া বা লৌকিক খেলা কি তা জানেও না। জানার চেষ্টাও করে না। তারা এখন কম্পিউটার, ল্যাপটব, ছোট বড় ট্যাব ও মোবাইলে ভিডিও গেমস খেলে সময় কাটায়। এ সব খেলা যে কতটা ক্ষতিকর তা জানে না শিশুরা। আর এসবের ক্ষতিকর দিকটা শেখায় না তাদের বাবা-মা বা অভিভাবকরা। দীর্ঘ সময় এসব যন্ত্রের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে শরীর ও মনে কি কি বিরূপ প্রভাব পড়ে তা অনুধাবন করে না শিশুদের মাতা-পিতারা। মা-বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে তারা দায় সাড়া জবাব দেন। শিশুরা কি করবে; অবসর সময় কিভাবে কাটাবে; তাই কম্পিউটার, ট্যাব, মোবাইলে ভিডিও গেমস খেলে সময় কাটায়।

কিন্তু ছেলেবেলায় তাঁরা কীভাবে সময় কাটিয়েছেন? তখন তো এখনকার মতো আধুনিক প্রযুক্তির দাপট ছিল না। ছিল না ভিডিও গেমস। পড়াশোনার পর উঠোনে আর মাঠে খেলাধুলা করেই সময় কেটেছে তাঁদের। সে সময় মফস্বল, শহর ও গ্রামের শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বাড়ির এক চিলতে উঠান, ছাদ বা খোলা মাঠে তেমন কোনো উপকরণ ছাড়াই গোল্লাছুট, নাটবল্টু, কানামাছি, বউচির মতো বহু ধরনের মজার খেলায় মেতে উঠত। দিনের শেষে সন্ধ্যায় বা জ্যোৎস্না রাতে সবাই যখন উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসত, তখন বাড়ির ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা খেলতো একেবারে সহজ খেলা কানামাছি।

কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ! ভীষণ সহজ আর খুব মজার একটি খেলা কানামাছি। কানামাছির পাশাপাশি এ অঞ্চলে হা-ডু-ডু খোলা ও নৌকাবাইচের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতি সপ্তাহে জেলার কোনো না কোনো নদ-নদী, বিল-বাওড়ে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়। তবে কানামাছি খেলার প্রসার-প্রচার না থাকলেও এটি শিশুদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা।
খেলায় টস করে একজনকে কানামাছি বানানো হয়। একখণ্ড কাপড় বা গামছা দিয়ে তার চোখ বেঁধে দেওয়া হয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় সে বন্ধুদের ছুঁয়ে দিতে চেষ্টা করে। বন্ধুরা মাছির মতো কানামাছির চারপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে আর তার গায়ে আলতো টোকা দিতে থাকে। সেই সঙ্গে তারা কানামাছি ‘ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ’ লাইনটি ছড়ায় ছড়ায় উচ্চারণ করতো। চোখ বাঁধা অবস্থায় কানামাছি যদি আশপাশের কাউকে ধরে ফেলে, তাহলে যাকে ধরে তাকেই হতে হয় কানামাছি। নতুন কানামাছিকে ঘিরে শুরু হয় আবার খেলা। কানামাছি খেলার প্রচলন কমে গেলেও এখনো অজপাড়া গাঁয়ের ছোট-খাটো উঠনে গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুরা কানামাছি খেলে থাকে। জেলার প্রায় প্রতি উপজেলার পল্লীতে দরিদ্র শিশুরা বিনোদন হিসেবে কানামাছি খেলে অবসর সময় কাটায়।

এদের অধিকাংশ শিশু প্রাইমারি স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশু। অভাবের কষাঘাতে তাদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে তাদের বাবা-মা। এমনই একটি দৃশ্য দেখা গেল মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের নিম্নকুমার নদের পাড়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের স্থাপিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা নদের পাড়ে একটি রেইট্রিতলা গাছের ছায়ায় সামান্য একটু খোলা জায়গায় কানামাছি খেলছে। এই প্রতিবেদককে দেখে ওরা সবাই লজ্জাবোধ করল। শিশুসুলভ আচরণ করায় ওরা বেশ আনন্দ পেল এবং আবার খেলা শুরু করল।  খেলাটি সরল ও সহজ এবং বেশ আনন্দদায়ক এবং শিশুতোষ খেলা। অনেকক্ষণ খেলার পরে ওরা একটু ক্লান্ত হয়ে খেলা বন্ধ করে দিল। ওদের খেলার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটি ছবিও তুললাম।

খেলা শেষে পাশের দোকান থেকে চকোলেট কিনে সবাইকে দিলাম। এরই মধ্যে স্কুলের ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেল। ওরা হাসিমুখে সালাম জানিয়ে যে যার মতো গুচ্ছগ্রামসহ আশপাশের নিজ নিজ বাড়ি চলে গেল। যাওয়ার সময় ওই স্কুলের শিক্ষার্থী মেহরাব, শরুফা, মরিয়ম, আফরিন, নুসরাত, আয়শা, হামিদ, সাদিয়া, আরিফা, ফাতেমা, তানিশা, সৈকত, তানহা, হালিমা, পল্লব রোহান কাজী, হাফসা, সিয়াম, মারুফা, সুফি আক্তারসহ আরও অনেকে তাদের অনুভূতি জানাল এইভাবে, ‘কানামাছি মাঝে মাঝে খেলি। বেশ আনন্দ লাগে। তবে সবদিন খেলতে পারি না। বাড়িতে কাজ করতে হয়। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাই। না হলে মা-বাবা বকাঝকা করে।’
স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনের সভাপতি ও স্কুলের পরিচালক ওহিদুজ্জামান কাজল বলেন, ‘আমরা শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপশি বিভিন্ন খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করে থাকি। ওরা তো সবাই অসচ্ছল সংসারের ছেলে-মেয়ে। আমাদের সাধ্যমতো ওদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লাভলু সাহেব ও মেম্বাররা খুবই আন্তরিক। তারাও আমাদের সাহায্য করেন।’   
বেশি দিনের কথা নয়, মাত্র ৫০/৬০ বছর আগেও বিকেল বা সন্ধ্যায় গ্রামের মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, বাড়ির উঠোনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে, নদ-নদীর পাড়ে উন্মুক্ত স্থানে যে সকল লোকক্রীড়ার ধুম পড়ে যেত, এখন আর সে সব খেলা চোখে পড়ে না। আধুনিক স্রোতের ধারায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার ৯০ভাগ। পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হাতে গোনা কিছু খেলা টিকে রয়েছে স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে। 

বিভিন্ন তথ্যমতে, দেশের সর্বত্রই মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ভিডিও গেম, যান্ত্রিক সভ্যতা, স্যাটেলাইট কালচারের বিকাশ, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামসহ নানা কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে গ্রামীণ খেলাধুলার পরিম-ল। তবে  শৈশব ও কৈশোরের সেসব খেলাধুলার স্মৃতি অনেককে আজও নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে। লোকক্রীড়ার পরিবর্তে বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোর-কিশোরীরা গা ভাসিয়ে দিচ্ছে যান্ত্রিক সভ্যতার অপসংস্কৃতির স্রোতে। হয় তো এমন একদিন আসবে যখন আমাদের ছেলে-মেয়েরা বাঙালি সংস্কৃতির লোকক্রীড়া ও লোকসংস্কৃতির প্রতিটি অনুষঙ্গ জাদুঘরে গিয়ে খুঁজবে! তখন আত্মপীড়ায় নিজেদেরকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করবে। আর অতীতের ভুল নিয়ে হাহুতাশ করবে।
এক সময় দেশের মধ্য ও ভাটি অঞ্চল মাদারীপুরে অসংখ্য লোকক্রীড়ার প্রচলন ছিল। এ সব খেলার মধ্যে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে বাঙালির ষোলোআনা বাঙালিয়ানা, জীবনধারা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। অজপাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষ নিজেদের শরীরচর্চা ও চিত্তবিনোদনের জন্য অসংখ্য খেলার জন্ম দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে পল্লী জীবনের সৃজনশীল মনের ছাপ পাওয়া যায়। প্রাচীনকাল থেকে বাংলার গ্রামগঞ্জ ছিল বিচিত্র সব খেলায় ভরপুর। এসবের মধ্যে ছিল- গোল্লাছুট, বউছি, লাটিম খেলা, এলান্ডি বেলান্ডি, সাত লাফ্ফা, সাত চাড়া, কানামাছি, কুতকুত খেলা, মাংস টোকানি, ছিকল (শিকল) চুরি, ফুল টোক্কা, টুনটুনানি খেলা, বরফ পানি, টি টি সাত পদ, ঝিমঝিমঝিম, মারবেল খেলা, পাথর খেলা, তিন গুটি খেলা, লুকোচুরি বা চোখ পলানতি, জোড়া বিজোড় খেলা, হা-ডু-ডু খেলা, কুমির কুমির খেলা, এপেন্টি বাইস্কোপ, উপুড় ও চিৎ সাঁতার খেলা, পুতুল খেলা, ড্যাংগুটি, ইচিং বিচিং খেলা, নাটবল্টু খেলা, চুড়ি ভাঙ্গা খেলা, স্টার্ট চুপ, নিমাই খোড়া খেলা, খিড়াই চুরি খেলা, নাতনি বুড়ি খেলা, নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, খেজুরপাতা খেলা, পাটখড়ি খেলা ইত্যাদি। এসব খেলা ৯০ ভাগ খেলা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোনোমতে টিকে আছে কানামাছি, হা-ডু-ডু খেলা, পুতুল খেলা, ড্যাংগুটি খেলা, গোল্লাছুট, মার্বেল খেলা, লুকোচুরি বা চোখ পলানতি, নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুতকুত খেলা ইত্যাদি।
অঞ্চলভেদে অধিকাংশ খেলার সঙ্গে রয়েছে ছড়ার ঘনিষ্ঠতা। অনেক খেলার মূল আকর্ষণই হচ্ছে আঞ্চলিক ছড়া। যেমন ‘ব্যাঙ মারবি যে, ব্যাঙের ভাতার সে’, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ’, ‘ঢেং ঢেং সোয়ারি বউয়ের মাথাত তাগারি/ বউ বড় ভারী, তালগাছের গুঁড়ি’, ‘পাকিরে পাকি/ আম ফেল্যা দে পাকা আমোত ক্যানে পোকা/ ধর শালীর খোঁপা’। দেশের কোন কোন অঞ্চলে এই খেলাগুলোর প্রচলন এখনো টিকে আছে।
শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সী নারী ও পুরুষের জন্য প্রচলন রয়েছে পৃথক খেলার। কোনো কোনো খেলা শুধুই মেয়েদের জন্য। আবার কোনো খেলা কেবল ছেলেদের জন্য। কিছু খেলায় ছেলে ও মেয়ে উভয়েই অংশ নিতে পারে। ঘরের খেলার যেমন কদর রয়েছে, তেমনি বাইরের খেলার কদর আরও বেশি। ডাঙার খেলা ছাড়াও পানির খেলা কম আনন্দদায়ক নয়। ডাংগুলি বা ডা-াগুলি গ্রামের ডানপিটে স্বভাবের চঞ্চল কিশোরদের প্রিয় খেলা। বাংলাদেশে প্রথম ক্রিকেট খেলার প্রচলন যখন ঘটে, তখন ক্রিকেটকে ডাংগুলি খেলার আধুনিক রূপ বলে মনে করা হতো।

গ্রামবাংলায় মার্বেল বা গুলিখেলা, লাটিম ঘোরানো, হাডুডু, গুলতি মারা ছিল কিশোরদের অতি প্রিয় খেলা। মেয়েদের খেলার মধ্যে চারকড়ি, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, কিতকিত, বুড়ির চি বা ছি ধরা, আঁচাবাটি বা টোপাভাতি, ঝুমুর ঝুমুর, গোল্লাছুট। এ সকল খেলার মধ্যে বেশকিছু খেলা কমন খেলা। পুতুল খেলা, জোড়-বেজোড়, বিশ কাঠি, ষোলো ঘুঁটি, এলাডিং বেলাডিং, উবু দুবু, চুড়ি ভাঙ্গা, লুডু খেলা ও বাঘবন্দী এসব ঘরে বসে খেলা যায়। এগুলো শহর, উপশহর ও গ্রামীণ জনপদের খেলা।
সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর

×