ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

করমজা চৌধুরী বাড়ি

ইতিহাসে সব ইতিহাস নেই, আছে শুধু স্মৃতি আর শ্রুতিতে...

মো. লুৎফর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ৮ আগস্ট ২০২৩

ইতিহাসে সব ইতিহাস নেই, আছে শুধু স্মৃতি আর শ্রুতিতে...

বাঁ থেকে- করমজা চৌধুরী বাড়ি, করমজা মধ্যপাড়ায় শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ

কাকেশ্বরী, আত্রাই আর ইছামতির পলিমাটি বিধৌত পাবনা জেলার সাঁথিয়া ভূখ-। নীলাকাশের নিচে ইছামতির তীরে গড়ে ওঠা এ উপজেলার রূপে অনেক বদল হয়েছে, হয়েছে নবতর জন্মতিথি। খুব বেশি দিনের না হলেও বিগত এক শতকের ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায় ওপরের নীলাকাশ যেমন ছিল তেমনি আছে। বদলে গেছে শুধু এখানকার মানুষের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মূলত এ ভূখ-ের ইতিহাসে সব ইতিহাস নেই। কিছু আছে স্মৃতিতে, কিছু আছে শ্রুতিতে।
প্রচীন ঐতিহ্যগুলোকে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ খুবলে খেয়েছে। অথবা চরম অযতœ আর অবহেলায় বেদখল হয়ে গেছে। এ সময়ের সিঁড়িতে পা রেখে প্রচীন কীর্তিকথা ভাবতে মনে প্রার্থনা জাগে, ‘আমারে ফিরায়ে লহ সেই সর্বমাঝে।’ 
সাঁথিয়া উপজেলার গ্রামাঞ্চলের পথের দু’ধারে এখানে সেখানে ছিল অনেক প্রচীন ঐতিহ্য আর কীর্তি।
উপজেলার করমজা একটি প্রাচীন গ্রাম ও বর্তমানে ইউনিয়ন। এক সময় করমজা পূজাখোলা সিদ্ধেশ্বরী কালী ও দুর্গা মন্দির প্রাঙ্গণে চৈত্র-সংক্রান্তিতে তিনদিনব্যাপী চড়কের মেলা হতো। সন্ন্যাসীকে বড়শিতে গেঁথে চড়ক গাছের সঙ্গে ঘোরাত। অন্যান্য সন্ন্যাসী জিহ্বায় তারশুল বিঁধিয়ে, তরবারির ওপর দিয়ে হেঁটে সকলকে চমক লাগিয়ে দিত। লোকশ্রুতি আছে সে মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হতো। এ ছাড়া মেলাতে বিচিত্রপণ্যের বাহারি পসরা সাজানো থাকত। ইদানীং আষাঢ় মাসে মন্দির প্রাঙ্গণে রথের মেলা বসে।
লোকমান ফকিরের গানের সুরে, ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা অঘ্রাণে/নবান্নে উৎসবে/সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়-/বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে।’ 
করমজা নিবাসী গোলাম মোস্তফা জানান, গোরস্তানের পূর্বপাশে সাপ্তাহিক হাট বসত। এ গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোন্তাজ আলী ওরফে চতুর নিজ নামে সিঅ্যান্ডবি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হাট বসান। এরপর থেকে এখানে আর হাট বসে না। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের প্রসিদ্ধ হাট-বাজারের একটি (চতুর হাট) বেড়া।
করমজা গ্রামটি ইছামতির তীর ঘেঁষে তিন ভাগে বিভক্ত। নদীর দক্ষিণ পাশে মূল করমজা, নদীর অপর পাশে পার-করমজা এবং উত্তর-পূর্ব পাশে পূর্ব করমজা (দত্তকান্দি)। পূর্বে এ গ্রামে চৌধুরী, মৈত্রী, স্যান্ন্যাল, ভূঁইমালী, সূত্রধর, জালিক, নাপিত, কর্মকার, পাল, লাহিড়ী, মল্লিক, নানা উপাধিক হিন্দু-মুসলমানের বসতি ছিল। এখানে ‘দাস’ উপাধিক সমতল ভূমিতে অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৬০টি পরিবারের বসতি এখনো আছে। ২০২৩ সালের জুন মাস হতে তাদের জীবন মানোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ধরনের সাহায্য প্রদান করা হয়।
করমজা গ্রামের মধ্যপাড়ায় একটি প্রাচীন দোতলা বাড়ি দেখতে পাওয়া যায় । অনেকে বলেন, তারিণীনাথ চৌধুরী এ বাড়ি নির্মাণ করেন। করমজা চৌধুরী বাড়ি নামে সর্বাধিক পরিচিত। দক্ষিণামুখী দোতলা বাড়িটি দু-ভাগে বিভক্ত। সরেজমিন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে লক্ষ্য করা যায়, ভবনের ভেতরের একটি খুঁটিতে নাম লেখ উৎকীর্ণ করা। সে লেখপাঠে জানা যায়, ভবানী প্রসাদ চৌধুরী ১৭৬৩ সালে বাড়িটি নির্মাণ করেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, কৌলাশ চন্দ্র চৌধুরীর পুত্র ভবানী প্রসাদ ছিলেন তরিণীনাথ চৌধুরীর পিতামহ। বর্তমানে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের অধীনে থাকলেও স্থানীয় প্রভাবশালী লোকেরা বাড়িটি দখল করে রেখেছে। কালের সাক্ষী হয়ে তাদের পুকুরটি এখনো আছে। এলাকাবাসীর কাছে এটা জেলা পরিষদের পুকুর নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
করমজা চৌধুরী বাড়ির প্রায় ৯৩ মিটার পূর্ব পাশে একটি একতলা ভবন ছিল। এটা ছিল মৈত্রী বাড়ি। নির্মাতা ছিলেন অতিন্দ্রনাথ মৈত্রী। মৈত্রী বাড়ি নামে এটা সমাধিক পরিচিত। বাড়ির সামনে একটি পুকুর আছে। এ বংশের লোকেদের অনেক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। চৌধুরী বাড়ির প্রায় ১৮৬ মিটার দক্ষিণে অপর একটি বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। স্থানীয় লোকেরা এটাকে বাগচী বাড়ি বলে জানেন। বাগচীরা ছিল চৌধুরীদের প্রতিদ্বন্দ্বী। উপেন্দ্রনাথ বাগচী এটি নির্মাণ করেছিলেন। এ বাড়ির আর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। বাগচী বাড়িতে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নতুন ভবন তৈরি করে বসবাস করেন।

ইছামতি তীববর্তী এ গ্রামের লোকেরা নৌকা বাইচ, যাত্রা গান, বাউল গান ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব আয়োজনের ব্যবস্থা করতেন। পূর্বে এ গ্রাম ধুপের গন্ধ আর ঢাকের শব্দে মুখরিত থাকত। করমজা ইউনিয়নে কয়েকজন বিখ্যাত বাউল ছিল। তারা হলেন ক্ষেপাউল্লাহ বয়াতি (আমাইকোলা), হাকিম বয়াতি (তলত), মজিবর প্রামাণিক (করমজা), ইসলাম বয়াতি (সানিলা)। এরা গ্রামবাসীদের পালাগানে মাতিয়ে রাখতেন। এখানে মসজিদ আর মন্দির, গোরস্তান আর শশ্মান পাশাপাশি। হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্পর্ক খুবই গভীর। 
শাহ আব্দুল করিমের কথায়, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/ গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান/মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম/হিন্দুগো বাড়িতে যাত্রা গান হইত/নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম/বাউলা গান, ঘাটু গান আনন্দের তুফান/ গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম, হায়রে/ বর্ষা যখন হইত, গাজির গান আইত/ রংয়ে ঢংগে গাইত আনন্দ পাইতাম/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’
করমজা মধ্যপাড়ায় ১৯৭১ সালে ৮ মে পাকিস্তানি সেনারা দশ জনকে নির্যাতনের পর হত্যা করে।

×