
দীর্ঘ নাটকীয়তা শেষে কুষ্টিয়ার কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে স্থান হয়েছে পথিকৃৎ সাংবাদিকের ব্যবহার করা মুদ্রণযন্ত্রটির
বেশ কয়েক বছর আগে কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠা করা হয় কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। গ্রামীণ জনপদে সুন্দর দুই তলা ভবন। সঙ্গত কারণেই সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। বিভিন্ন নিদর্শন রেপ্লিকা ছবি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছিল জাদুঘরের গ্যালারি। একই ভবনে ছিল পাঠাগার ও ব্যবহারযোগ্য মিলনায়তন। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা এখানে আসতেন। তবে কাঙাল হরিনাথের মূল স্মৃতি ধরে রেখেছিল তাঁর ব্যবহার করা এমএন প্রেস। প্রেসটি সেখানে ছিল না। ফলে জাদুঘর থেকে শেষতক হতাশা নিয়েই ফিরে যেতে হতো দর্শনার্থীদের। এভাবে লম্বা সময় চলার পর অতি সম্প্রতি এসেছে বড় পরিবর্তন। দীর্ঘ নাটকীয়তা শেষে জাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়েছে প্রেসটি। কাঙালের ধনে শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে জাদুঘর। একই ধন সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের!
এবার একটু পেছনে ফেরা যাক, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার দিক থেকে দারুণ সমৃদ্ধ একটি জেলার নাম কুষ্টিয়া। এই জেলার কুমারখালীতে সাধক পুরুষ লালনের আখড়া। শিলাইদহে আছে রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি। মীর মশাররফ হোসেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ লিখেছিলেন এখানে বসে। একই জেলার কু-ুপাড়াকে সবাই চেনেন বিখ্যাত কাঙাল হরিনাথের জন্য। তিনি ছিলেন গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। লেখালেখির পাশাপাশি পত্রিকা বের করতেন তিনি। সাহিত্য চর্চাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনন্য ইতিহাস গড়েছিলেন তিনি। জন্ম ১৮৩৩ সালে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। একাডেমিক লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি। তবে শিক্ষিত যে ছিলেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা পত্রিকায় লিখতেন তিনি। প্রথম দিকে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতো।
পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে সংবাদপত্র প্রকাশ করে নতুন ইতিহাস রচনা করেন তিনি। প্রথমে ছিল মাসিক প্রকাশনা। পরে পাক্ষিক। তারও পর সাপ্তাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। এক পয়সা মূল্যমানের পত্রিকাটি নীলকরদের অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৮৭৩ সালে কাঙাল স্থাপন করেন ঐতিহাসিক এম এন প্রেস। বিদেশ থেকে আনা নিজের প্রেসেই ছাপা হতে থাকে পত্রিকা। শত সীমাবদ্ধতা, অর্থ সংকট, সর্বোপরি শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দীর্ঘ ২২ বছর এই প্রেসে প্রকাশনা অব্যাহত ছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ পত্রিকার মাধ্যমেই ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সাহিত্যিক রায় বাহাদুর জলধর সেন, দীনেন্দ্র কুমার রায়, মীর মশাররফ হোসেন, শিবচন্দ্র বিদ্যানর্ব প্রমুখ সাহিত্যিকের জন্ম হয়। যতদূর জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেনের কালজয়ী রচনা ‘বিষাদ সিন্ধু’ হরিনাথের এমএন প্রেস থেকেই প্রথম প্রকাশিত হয়। লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’সহ মোট ২১টি গান সর্বপ্রথম ছাপা হয় এমএন প্রেসে। এসব কীর্তি গড়ে ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল পৃথিবী থেকে বিদায় নেন কাঙাল হরিনাথ। তবে তার এম এন প্রেস সংবাদপত্র ও সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের অমূল্য স্মারক হয়ে টিকে ছিল। পরিবারের অধিকারে ছিল প্রেসটি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে প্রেসটি সবাই দেখতে যেতেন। ভাঙা ঘরে মাটির মেঝেতে রাখা প্রেসটি সংরক্ষণের দাবিও ক্রমে জোরালো হতে থাকে। তবে পরিবারের সদস্যরা পূর্ব পুরুষের এই স্মৃতি চিহ্ন হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না। কখনো আবেগ, কখনো ব্যক্তিগত লাভ ক্ষতির হিসাব তাদেরকে বিভ্রান্ত করত।
তবে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এই স্মৃতি নিদর্শন রক্ষার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিল। পরিবারের সঙ্গে এ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে কথা হচ্ছিল তাদের। এক পর্যায়ে কিংবদন্তির ভিটার কাছেই ২০১৭ সালে কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানেই প্রেসটি স্থাপনের পরিকল্পনা করে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অযুত কথাবার্তা ও চিঠি চালাচালির পরও প্রেসটি সরকারের অধীনে দিতে পরিবারের সদস্যরা রাজি হচ্ছিলেন না। অবশেষে কয়েক দিন আগে ২০ লাখ টাকা ও পরিবারের দুই সদস্যের চাকরির বিনিময়ে প্রেসটি জাদুঘরে দিতে সম্মত হয় পরিবার। এ উপলক্ষে ঢাকায় এসে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন পরিবারের সদস্যরা।
তখন কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের পঞ্চম বংশধর দীপঙ্কর মজুমদার জানান, ২০ লাখ টাকার চেক ও দুজনের চাকরির বিনিময়ে তার মা প্রেসটি হস্তান্তরের চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেছেন। চেকটি তারা হাতে পেয়েছেন। এখন আর প্রেসের সত্ত্ব ছাড়তে দ্বিধা নেই তাদের।
তবে চুক্তি সাক্ষরের পরেও জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তা নাসির খান। প্রেসটি স্মৃতি জাদুঘরে স্থাপন করতে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। কাজ শেষে ঢাকায় ফিরেছেন। অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে বলেন, যেদিন প্রেসটি তাদের বাসা থেকে বের করা হবে সেদিন পরিবারের কেউ কেউ বলছিলেন, এই দিনে বাসা থেকে কিছু বের করা কল্যাণকর নয়। অর্থাৎ প্রেসটি ঘিরে তাদের আবেগটা কিছুতেই সংবরণ করতে পারছিলেন না। অবশেষে প্রশাসনের সহায়তায় জাদুঘরে প্রেসটি বসানো হয়েছে। এর ফলে জাদুঘরটি পূর্ণতা পেল বলে জানান তিনি।