ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করা মমিন এখন প্রভাষক

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ২০:২০, ১ এপ্রিল ২০২৩

রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করা মমিন এখন প্রভাষক

প্রভাষক মমিন 

দারিদ্র্যতার কাছে হার মানেনি দিনমজুর মমিনুর ইসলাম (৩০), নামের এক যুবক। পড়াশোনার খরচ যোগাতে নিজে দিনমজুরের কাজ ও রিকশা চালিয়ে পড়াশুনা করেছে। অধম্য এই মেধাবী এই যুবক শিক্ষক নিবন্ধন পরিক্ষায় মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হয়ে কুড়িগ্রাম আলিয়া মাদ্রাসায় ইংরেজি বিষয়ে প্রভাষক হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। মমিনুরের সফলতায় গল্প কুড়িগ্রাম শহরের মানুষের মুখে মুখে।

সংগ্রামী এই যুবকের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের মধ্যেকুমরপুরের সফপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম মো. নুর ইসলাম ও মা  ময়না বেগম। তিন ভাই বোনের মধ্যে মমিনুর সবার বড়।

২০০৯ সালে সদরের মধ্যেকুমরপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি ও ২০১১ সালে নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরে তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজি বিষয়ে অর্নাস ও মাস্টার্স শেষ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মমিনুর রহমান এক সময় ক্ষেত খামারে কাজ ও রিকশা চালিয়ে নিজের খরচ জুগ্রিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের স্নাতকে। তিনি ইংরেজি বিষয়ে প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত আর্থিক সঙ্কটে পড়ে বার বার ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালিয়ে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। 

দারিদ্রতার কারণে দফায় দফায় পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও দৃঢ় মনোবল আর পরিশ্রম করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। আর পড়াশোনা শেষে সংগ্রামী এই যুবক স্থানীয় কুড়িগ্রাম জেলা শহরের আলিয়া মাদরাসায় প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। রিকশাচালক থেকে তিনি এখন ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক। 

তবে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় সারাদেশের তৃতীয় স্থান অধিকার করেন মমিনুর। এ বছর ১০ মার্চ কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদ্রাসায় ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন তিনি। অধম্য মেধাবী মমিনুর রহমান জানান আমি যখন এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই প্রাইভেট পড়ার জন্য স্যারের বাড়িতে যাবো কোন ব্যবস্থা ছিল না। তখন আমি মায়ের কাছে কান্নাকাটি করি। তখন নানার বাড়ি থেকে একটা পুরাতন সাইকেল পাই। তা দিয়ে প্রাইভেট পরতাম। কিন্তু স্যারদের বেতন দিতে পারি নাই। অনেক কষ্ট করে এইচএসসি পাস করার পর ভর্তি হই কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে। এক সময় মানুষের জামাকাপড় পড়ে কলেজ করতাম। 

তিনি আরও বলেন, অর্নাসে পড়ার সময় বহুবার  ঢাকার কেরানিগঞ্জে গিয়ে রিকশা চালিয়ে টাকা রোজগার করেছি।  এছাড়াও ধানকাটার জন্য কুমিল্লাও গিয়েছি। দিনের পর দিন ধান কেটে পড়াশুনার খরচ চালিয়েছি। এতে আমি কখনও হতাশ হয়নি। আমি মনে করি জীবনের প্রয়োজনে ছাত্ররা রিকশা চালাবে, ভ্যান চালাবে, কৃষি কাজ করবে, শ্রমিকের কাজ করবে ও দিন মজুরী করে পড়াশুনা চালিয়ে যাবে। এটাও এক জীবন যুদ্ধ। তিনি বলেন আমি যদি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পড়াশুনার জন্য কাজ না করতাম তাহলে প্রভাষক হতে পারতাম না।এখন স্বপ্ন দেখি বিসিএস ক্যাডার হবার। সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখনও আমার বয়স আছে বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার।

তার বাবা নুর ইসলাম বলেন, দিনমজুরের কাজ করে কোনরকমে সংসার চালাতাম। ছেলে যখন এইচএসসি পাস করার পর থাকে আর একটি টাকাও খরচ দিতে পারি নাই। ছেলে নিজে দিনমজুরের কাজ ও ঢাকায় রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করেছে। আমি অনেক খুশি। 

মা ময়না বেগম বলেন, আমার ছেলে হওয়ার পর থেকে আমার সংসারে খুব অভাব ছিল। ঠিকমত ভাত খেতে পারি নাই। জামাকাপড় দিতে পারি নাই। খুব কষ্ট ছিলো। অনেক কষ্ট করি ছেলে আমার লেখাপড়া করছে। মানুষের কাপড় পরে স্কুল কলেজে গেছে। আমরা দিতে পারি নাই।

মমিনুরের প্রতিবেশি মিজান মিয়া বলেন, নিজ চোখে দেখেছি মমিনুর ছোট থেকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। তার কষ্টের শেষ ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল হয় তো ভালো কিছু করার। সে আজ সফল হয়েছে। কলেজে ইংরেজি বিষয়ে প্রভাষক হয়েছে। আমরা দোয়া করি তার কাছ থেকে যেন মানুষ অনেক কিছু শিখতে পারে। 

কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মির্জা নাসির উদ্দিন বলেন, মমিনুর রহমান সারাদেশের শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় মেধাতালিকায় তত্বীয় অবস্থান করে এখন ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছে। সে আমাদের কলেজের ছাত্র, সে কুড়িগ্রামের গর্বিত সন্তান।

 

এমএস

×