
শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল। ছবি: জনকণ্ঠ
শরীয়তপুরে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-আয়ের মানুষের চিকিৎসা সেবার অন্যতম ভরসাস্থল শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল। এ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে ও কতিপয় ডাক্তারদের স্বেচ্ছাচারিতায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। আবার কিছুদিন পরপর যেসব যন্ত্রপাতির আছে তা অচল হয়ে পড়ে থাকে।
ফলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এই সুযোগে কমিশনভোগী এক শ্রেণির অসাধু চিকিৎসক রোগীদের রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষার জন্য বাইরের বেসরকারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে নিজেদের পকেট ভারি করছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। শুধু শরীয়তপুর সদর নয়, আশপাশের উপজেলা ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা, গোসাইরহাট, নড়িয়া ও জাজিরা থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। তারা কেবল চিকিৎসক দেখানো ছাড়া ডায়াগনোস্টিক পরীক্ষা বা অন্য কোন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না।
হাসপাতালে ডিজিটাল এক্সরে মেশিনে রোগীর এক্স-রেসহ নামমাত্র কিছু রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া অন্যান্য উন্নত পরীক্ষার জন্য নেই সিটিস্ক্যান, এমআরআই, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন।
ডিজিটাল এক্সরে মেশিন থাকার পরও চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের দুই-তিন গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে বেসরকারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হচ্ছে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রায় প্রতিদিন রোগীদের লম্বা লাইন লেগেই থাকে। রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা করাতে ছুটছেন বেসরকারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে।
ভুক্তভোগী রোগী শফিকুল ইসলাম বলেন, তার এক্সরে করানো দরকার। কিন্তু যন্ত্রপাতি না থাকায় বাইরে থেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে পরীক্ষা করাতে হয়েছে। হাসপাতালে করাতে পারলে ২০০ টাকা লাগত।
ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী রনি, সেফালি, নুরুন্নাহারসহ অনেকে বলেন, ডাক্তাররা আমরাদের ঠিক মতো দেখতেও আসে না।
এদিকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে মেডিক্যাল সার্টিফিকেটের রমরমা বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
খোদ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুস সোবহানের নেতৃত্বে অন্যান্য জামায়াত-বিএনপিপন্থী কয়েকজন ডাক্তারদের সমন্বয়ে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বিক্রির এ সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে ওঠেছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সিম্পল ইনজুরিকে গিরিভিয়াস আবার মরাক্তক জখম হলেও তাকে দেয়া হচ্ছে সিম্পল সার্টিফিকেট। এতে আদালতে মারামারি মামলার বিচারপ্রার্থীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
হাসপাতাল সূত্র ও স্থানীয়রা জানান, ডা. আব্দুস সোবহান ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর থেকেই তার সমমনা অর্থোপেডিক্স ডা. মোহাম্মদ আকরাম এলাহীসহ কতিপয় ডাক্তারের যোগসাজশে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বিক্রির সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে ডা. আবদুস সোবহান অফিস চলাকালীন বেসরকারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে প্র্যাকটিসে চলে যান। কোন অপারেশনের রোগী এলেই ক্লিনিকে পাঠানোর চেষ্টাসহ হাসপাতালের দামি ওষধ ক্লিনিকে পাচারের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
অস্বাভাবিক মৃত্যুর লাশের ময়না তদন্তের রিপোর্ট ও মারামারি রোগীর সার্টিফিকেট বিক্রিসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। এসব অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এক লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে, সদর উপজেলার দরিচর দাতপুরের ইসহাক ফকির হত্যা মামলার অন্যতম আসামী এনামুল হক নামের এক শিবির কর্মীকে ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে আউটসোর্সিং থেকে সদর হাসপাতালে চাকরিতে যোগদানের সুযোগ করে দিয়েছেন ডাক্তার আব্দুস সোবহান। ওই এনামুল হককে নিজের পিএস হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে অপারেশন রোগী ধরার কাজে ব্যবহার করছেন বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
এদিকে ডাক্তার আকরাম এলাহী অর্থোপেডিক ডাক্তার হওয়ায় যেকোন মারামারীর রোগীর ক্ষেত্রে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট নিতে হলে তার স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। কিন্তু ডাক্তার আকরাম এলাহী প্রতিটি সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করতে প্রকাশ্যেই ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন।
এছাড়া ডা. আকরাম এলাহীর বিরুদ্ধে রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা ও নানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেই প্রাইভেট ক্লিনিকে চলে যান তিনি। এসব অনিয়ম নিয়ে প্রতিবাদ করায় সম্প্রতি এক রোগীকে চেম্বারে বসেই পিটিয়েছেন তিনি।
জামায়াতপন্থী ডা. আব্দুস সোবহান হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগদান করার পর থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, গ্রুপিং আর স্বেচ্ছাচারিতায় ভেঙে পড়েছে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। এসব বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি ডা. আকরাম এলাহী।
মুঠোফোনে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. আবদুস সোবহান ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আপনারা যা পারেন লিখেন। আমি আপনাদের কাছে কেনো তথ্য দিতে বাধ্য নই। আপনারা আমাকে প্রশ্ন কারার কে?
এসআর