ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

ছয় ডিসেম্বর রাজাকারদের ব্রীজে উঠিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয় 

জিয়াউল হক, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ১৮ মার্চ ২০২৩

ছয় ডিসেম্বর রাজাকারদের ব্রীজে উঠিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয় 

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক খান

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক খান। ভরপাশা ইউনিয়নের কৃষ্ণকাঠি গ্রামের মৃত আমজেদ আলী খানের পুত্র তিনি। 

৮৪ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক খান মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছয় ডিসেম্বর টানা তিন দিনের যুদ্ধে শতাধিক থানার পুলিশ ও আল-শামস, রাজাকার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। আমরা তখন থানার ওসি মালেক সহ পুলিশ সদস্য, রাজাকার, আল-শামস শতাধিক সদস্য গ্রেপ্তার করে পাদ্রীশিপুর সেন্ট আলফ্রেড হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে যাই। বিক্ষুব্ধ জনতারা ওসি মালেককে রশি বেঁধে শ্রীমন্ত নদীর পানিতে ডুবিয়ে মারে। ওইদিন রাজাকারদের নেতৃত্বদানকারী সাহু রাজাকার, লতিফ রাজাকার সহ ৭/৮ জন রাজাকারদের পাদ্রিশিপুর গির্জার সামনে ব্রীজে উঠিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। 

১৯৬১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পাক নৌবাহিনীতে যোগদান করি। তৎকালীন পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে চিফ মাস্টারের দায়িত্বে ছিলাম। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পাকিস্তানের করাচি থেকে ৬০ দিনের ছুটিতে বিমানযোগে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় এসে পৌছাই। এরপর ঢাকা থেকে নিজ গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জে অবস্থান করি। বরিশালে আসলে পরে আর পাকিস্তানে যাওয়া হয়নি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গড়ে তোলা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। 

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুরে কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরীর (নাটুবাবু) জমিদার বাড়িটি এই অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি ছিল। ২৫ মার্চের পর বরিশাল অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয় জমিদার বাড়িটি। তখন ক্যাপ্টেন নাসিরের ৯ নম্বর সেক্টরে আমি সহ বাকেরগঞ্জের অনেক মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাদ্রীশিপুর সেন্ট আলফ্রেড হাই স্কুলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। 

মুক্তিযুদ্ধকালে ১৫ নভেম্বর স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গভীর রাতে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। সেদিন সম্মুখ যুদ্ধে তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৫/৭ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হন। 

ওই যুদ্ধে ৩৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করে পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা। তখন শ্যামপুর বাজার আশেপাশে বাড়ি ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা। ওই রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাক সেনারা।

১৯৭১ সালে মক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা দানের লক্ষ্যে গঠিত হয় আধা-সমারিক বাহিনী আল-শামস ও রাজাকার বাহিনী। 

যুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ থানার ওসি মালেকসহ থানার পুলিশ ও আল-শামস ও রাজাকার বাহিনীরা থানায় ঘাঁটি বসিয়ে পাক বাহিনীদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ও ঘাঁটিতে হামলা চালাত। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে আমরা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা থানা ঘেরাও করি। 

মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা তৈয়ব আলী মৃধা, মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা তৈমুর গাজী, মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজেম আলী খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন সহ বাকেরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা বাকেরগঞ্জ থানা ওসি মালেকসহ পুলিশ,রাজাকার, আল-শামস বাহিনীর প্রায় তিন শতাধিক সদস্য থানায় অবস্থানকালে তাদের ঘাঁটি দখল করতে তিন দিন যুদ্ধ করি। 

তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান খান কমান্ডার এর দায়িত্বে ছিলেন। আমি তখন ডিপুটি কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলাম। ওই সময় ৫ ডিসেম্বর সম্মুখযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেন্টু শহীদ হন। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সেন্টু দাড়িয়াল ইউনিয়নের বীর সন্তান। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক খান বাকেরগঞ্জের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমি সহ শ্যামপুর ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এসআর

×