ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

একটানা চারদিন যুদ্ধ করি

মো. হারেজুজ্জামান হারেজ, সান্তাহার

প্রকাশিত: ০০:২৫, ১৭ মার্চ ২০২৩

একটানা চারদিন যুদ্ধ করি

তহির উদ্দিন

বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সদর ইউনিয়নের ডহরপুর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা তহির উদ্দিন। ৭৭ বছর বয়সী তহির উদ্দিন মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সন্ধ্যার পর আমার জন্মস্থান সান্তাহার ইউনিয়নের কায়েতপাড়া গ্রামের মোড়ে মোড়ে মানুষের জটলা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নিরক্ষর এবং কিশোর হলেও তাদের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় এক সভার মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন।

এরপর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সান্তাহার শহরে প্রবেশ করার পর থেকে আশপাশের গ্রামে হামলা চালাতে শুরু করে। স্থানীয় রাজাকার ও বিহারিরা হানাদারদের পথ দেখিয়ে গ্রামের পর গ্রামে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতে থাকে। লুট করতে থাকে গৃহপালিত পশু-পাখি, ধান-চাল ও আসবাবপত্র। বাবা-মা ও ভাই-বোন ভয়ে পালিয়ে কোথায় গেছে তখনো জানি না। ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকার সময় পেলাম প্রতিবশী বড় বাবাকে।

তার সঙ্গে সারাদিন মাঠে খেত-খামারে কামলার কাজ করি। রাতের বেলা পোড়া বাড়িতে ঘুমাই। দিন যায় আর শত্রুদের অত্যাচার বাড়তে থাকে। এভাবে পেরিয়ে গেল এক মাস। এ সময় মাঠে কাজ করতে গিয়ে দেখা হয় পাশের কলসা (কোচকুড়িপাড়া) গ্রামের বাল্যবন্ধু আব্দুল জব্বারের সঙ্গে। দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলাম, অনেকের মতো আমরাও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাব।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরদিন দুই বন্ধু হাঁটা দিলাম ভারতের উদ্দেশ্যে। দুই দিনের বেশি সময় হেঁটে নওগাঁর কালুপাড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। চলে যাই বালুঘাট। তারপর মধুপর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। সেখানে আমাদের দুই বন্ধুকে সাদরে গ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ, মজিবর রহমান আক্কেলপুরি, আমাদের এলাকার এমপি কছিম উদ্দিন আহমেদ ও তার ভাজিতা নাসির উদ্দিন টুকু। পরিচয় শেষে ওই ক্যাম্পে ভর্তি করে নেয়।

সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যায় কামারপাড়া ক্যাম্পে। সেখানে প্রথমে আমাদের টিকা দেওয়া হয়। পরে বিশ্রাম ও গোসল শেষে অনেকের সঙ্গে খাবার দেওয়া হয়। পরদিন নিয়ে যায় পতিরাম প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। পতিরাম ক্যাম্প থেকে নিয়ে যাওয়া হয় শিলিগুড়ি। এখানে ২১ দিন ধরে প্রায় সব ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের ভারতের মালদহের মেহেদীপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট আওয়াল, কর্নেল তাহের এবং ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও আজিজুল বারী নামের পাঁচ অফিসার।

তারা প্রত্যেকে ২১০ জন মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। তাঁরা সব সময় ছদ্মবেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গতিবিধি এবং আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথঘাট রেকি করে বেড়াতেন। তারা সব কাজ শেষ করে ডিসেম্বর মাসের শুরুতে আমাদের নিয়ে আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কলাবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে শিবগঞ্জ থানা এলাকায়। শিবগঞ্চ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে যায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা তহির উদ্দিন বলেন, চাঁপাইয়ের ইপিআর ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিশাল ক্যাম্প। পাকিস্তানিরা আমাদের অগ্রসর হওয়ার বিষয় জেনে ফেলে এবং ১০ ডিসেম্বর থেকে তারা আমাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। জবাবে আমরাও প্রতিরোধ গড়ে সামনে এগোতে থাকি। এই যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আশপাশে ও পেছনে একেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হওয়ার সময় ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।

পাশাপাশি আমাদের গুলিতে বহু হানাদার সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়। কিন্তু সে মুহূর্তে লাশ গোনার কোনো সুযোগ ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা ও হানাদারদের মিলিত রক্তের ¯্রােত দেখে আমরা অনেকে ভয় পেয়ে যাই। বিষয়টি কমান্ডিং অফিসাররা বিশেষ করে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর বুঝতে পেরে আমাদের নানাভাবে সাহস দিতে থাকেন। এভাবে চারদিন চার রাত সম্মুখযুদ্ধের পর ১৪ ডিসেম্বর সকালে আমরা চাঁপাইয়ের ইপিআর ব্যাটালিয়নে করা পাকিস্তানি ক্যাম্প দখল করে নেই। আমাদের সাঁড়াশি আক্রমণে পাকিস্তানিরা ক্যাম্প ছেড়ে গিয়ে অবস্থান নেয় চাঁপাই শহরে।

এরপর সকাল ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরসহ অন্য অফিসাররা আমাদের নিয়ে হানাদারদের ক্যাম্পে যাওয়ার আগে ছদ্মবেশে বের হয় আশপাশের পরিস্থিতি রেকি করার জন্য। কিছু দূর যাওয়ার পর একটা বাঙ্কারে এক পাকিস্তানি সৈন্যের সামনে পড়েন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ওই সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন, কিন্তু সে ‘জাহাঙ্গীর স্যার’কে গুলি করে দেয়। তার এক কানে গুলি লেগে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে শহীদ হন তিনি।

এরপর ওই বাঙ্কারের দক্ষিণ দিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যাপক ফায়ার শুরু করে। সেই ফায়ারের শব্দ পেয়ে পাকিস্তানিরা চাঁপাই শহর থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ও গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। এ সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কিছুক্ষণ পর সহযোদ্ধা পাবনার আবুল হোসেনের সহযোগিতায় জ্ঞান ফিরে পাই। এ সময় আমাদের কমান্ডিং অফিসাররা কৌশল অবলম্বন করেন। পাকিস্তানিদের গুলি ও গোলার জবাব না দিয়ে নীরব থাকার নির্দেশ দেন।

সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানিদের গুলি ও গোলাবর্ষণ বন্ধ হওয়ার পর শহীদ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর দুই/তিন দিন পরে আমরা ওই ক্যাম্পে ঢুকে অবাক হয়ে যাই। চারদিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের লাশ আর লাশ। সেই সঙ্গে ছিল বিশাল অস্ত্র ভা-ার। দেশ এবং ওই এলাকামুক্ত হওয়ার পরও সেখানে আমরা ১৭ দিন ছিলাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইপিআর ক্যাম্প ও আশপাশের পুকুর-জলাশয় থেকে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া হাজার হাজার অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এরপর আমাদের নিয়ে আসা হয় জয়পুরহাটে। জয়পুরহাটের কুখ্যাত রাজাকার যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলিমের পাটের গুদাম দখল করে বানানো ক্যাম্পে আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
তিনি বলেন, মাসে বেতন দেওয়া হত ৫০ টাকা করে। এ সময় কর্নেল তাহের আমাদের বললেন, যারা চাকরি করতে চান, আমাকে বলবেন। আমি ব্যবস্থা করে দিব। এখন আদমদীঘি উপজেলা সদর ইউনিয়নের ডহরপুর গ্রামে নড়বড়ে বাড়িতে ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ কষ্টে থাকার কথা জানান রণাঙ্গনের এই মুক্তিযোদ্ধা। অনেক সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা সরকারের উপহার ‘বীর নিবাস’ পেলেও তিনি না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন।

×