ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

এমএমজি দিয়ে পাকিস্তানি ওয়াচ টাওয়ার ধ্বংস করে দেই

লিখন আহমেদ, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:৪৯, ১৫ মার্চ ২০২৩

এমএমজি দিয়ে পাকিস্তানি ওয়াচ টাওয়ার ধ্বংস করে দেই

ইসহাক খান

১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের সব স্তরের মানুষ। বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতা। হানাদারদের বিরুদ্ধে যারা মরণপণ লড়াই করেছেন তাদেরই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ ইউনিয়নের কানসোনা গ্রামের ইসহাক খান। 
‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বুকে ধারণ করে দেশকে মুক্ত করার লড়াইয়ে যোগ দেন ইসহাক খান। কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে ইসহাক খান বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে শপথের পরের দিনই আমাদের যাত্রা। কোনো অবসর বা বিশ্রামের সময় ছিল না। আমাদের বিদায়ের পর অন্য একটি দলের প্রশিক্ষণ শুরু হবে এখানে। এটা চলমান প্রক্রিয়া।

প্রশিক্ষণ স্থল থেকে আমাদের বিদায়ের সময় মন খারাপ হয়েছিল। ওস্তাদসহ সকলের চোখ বেয়ে জল বেরিয়ে ছিল। ওস্তাদ সেদিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন ‘আমি চাই তোমরা তোমাদের মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত কর। তোমাদের দেশের স্বাধীনতার পতাকা আকাশে উড়তে থাকুক। তোমরা বিজয়ী হলে মনে করব আমিও বিজয়ী হয়েছি।’ ওস্তাদের সেই কথাগুলো আজো কানে বাজে।

আমরা ট্রাকে করে রওনা হলাম। বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে আমাদের ট্রাক ছুটে চলেছে। যাত্রার মুহূর্তে জয়বাংলা ধ্বনিতে আমরা গর্জে উঠলাম আকাস বাতাস কাঁপিয়ে। জয়বাংলা আমাদের রণসংগীত। যুদ্ধজয়ের প্রেরণা। রক্তে উন্মাদনা বাড়ায়। মনকে চাঙ্গা করে। সাহস জোগায়। দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে এ ক্যাম্প মাইল দেড়েক ভারতের ভেতরে। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প আর পাকিস্তানিদের কামালপুর ঘাঁটি বলা যায় মুখোমুখি। মাঝে দূরত্ব দশ মাইলের মতো।

পাকিস্তানিরা ইচ্ছা করলে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে শেল নিক্ষেপ করতে পারে। ওই ক্যাম্প তাদের শেলিং রেঞ্জের মধ্যে পড়ে। অনুরূপভাবে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে কামালপুর পাকিস্তানি ঘাঁটিতে শেল নিক্ষেপ সম্ভব। কিন্তু উভয় দেশ তারা নিজেরা সংযম রক্ষা করে চলেছে। যুদ্ধ তখন পাকিস্তানি আর বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। 
মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প উঁচু পাহাড়ের ওপর অনেক বড় একটি ক্যাম্প। একপাশে পাকা রাস্তা। রাস্তায় চলাচল করা মানুষদের ছোট বামনদের মতো মনে হয়। বাকি তিন দিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। বিশাল জায়গাজুড়ে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প। ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন ক্যাম্পটির এক পাশে লম্বা টিনের ঘর। আরেক পাশে লম্বা করে তাঁবু টানানো। ভেতরেও অনেকগুলো তাঁবু। যার একটিতে থাকতেন সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের। ডেপুটি কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন আহমেদ। প্রায় পাঁচ হাজার মুক্তিযোদ্ধার অবস্থান সেখানে। 
আমাদের সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের। যিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। যুদ্ধে তিনি একটি পা হারান। তিনি বলেন, একটি টিনের ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। মেঝেতে টানা বিছানা করে শোয়ার ব্যবস্থা। বিকেলে আকস্মিকভাবে আমার পাশের গ্রামের আক্তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। আক্তার ভাই আমাকে দেখে একই সঙ্গে আনন্দিত এবং বিস্মিত। সেখানে আমার দুলাভাই রফিকুলও ছিলেন তাকে কয়েকদিন আগেই সেখান থেকে অন্যত্রে বদলি করায় তার সঙ্গে দেখা না হওয়ায় মন খারাপ হলো। আক্তার ভাইকে ক্যাম্পে সবাই ওস্তাদ বলে ডাকতেন। তিনি আমাকে সাহস এবং পরামর্শ দিলেন। 
পরের দিন আমাদের যুদ্ধযাত্রা শুরু। ভোরে আমাদের পেটে ঘুষি মেরে ঘুম থেকে তোলা হলো। এটা যুদ্ধের ময়দানের নিয়ম। আমরা ২৫/৩০ জন চোখ কচলাতে কচলাতে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদের বলা হলো কামালপুর সেক্টরে অপারেশনে যেতে হবে। একজন লেফটেন্যান্ট আমাদের কমান্ডার হিসেবে থাকবেন। কামালপুর সেক্টরের নাম শুনে গলাবুক শুকিয়ে গেল। ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক সেক্টর। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ওই ফ্রন্টে শহীদ হয়েছেন। আমরা ভোরে কামালপুর সেক্টরের দিকে রওনা হলাম।

সকলের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে বের হলাম। কারণ কামালপুর ফ্রন্ট থেকে ফিরে আসা অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার।  প্রথম যুদ্ধ অন্যরকম অনুভূতি তবে আমরা যাচ্ছি সাহায্যকারী হিসেবে। আমাদের কমান্ডার এমএমজি (মিডিয়াম মেশিন গান) চালাবেন। আমরা থাকব জোগানদার হিসেবে। সেদিনের যুদ্ধে আমার সঙ্গে কাছের বন্ধু আসগরও ছিল। লুঙ্গি উল্টো করে বেঁধে নিয়ে আমাদের প্রথম যুদ্ধযাত্রা। 
ময়মনসিংহের কামালপুর পাকিস্তানিদের ঘাঁটির ৫/৬ মাইল আওতার মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি। সম্ভবত ওরা আমাদের দেখতে পায়নি। সব প্রস্তুতি শেষে কয়েক দফা গোলাগুলি হলো। বন্ধু আসগরের লুঙ্গি খুলে যাওয়ায় বড় ধরনের বিপদে পড়তে হচ্ছিল। আমি তাকে সাবধান করতেই সে লুঙ্গি হাতে ধরে পজিশন চেঞ্জ করলে সেদিন প্রাণে বেঁচে যায় আসগর। বিরতিহীনভাবে যুদ্ধ চলছিল।

লেফটেন্যান্ট তার তীক্ষœ দৃষ্টি দিয়ে বায়নোকুলারের সাহায্যে নতুন করে অবস্থান নিয়ে এমএমজি সেট করে ফায়ার করতে লাগলেন। আমরা আগের মতো মাটিতে শুয়ে কান চেপে ধরলাম। টানা কয়েক মিনিট ফায়ারিং শেষে লেফটেন্যান্ট স্যার উচ্ছ্বাস নিয়ে উঠে বসলেন। বললেন, ‘অপারেশন সাকসেসফুল।’ তিনি বললেন, ওদের কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ারের মধ্যে একটি উড়িয়ে দিয়েছি।’ শুনে আমরাও উচ্ছ্বাসে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। স্যার বললেন, ‘ওই ওয়াচ টাওয়ারে যে ক’জন পাকিস্তানি আর্মি ছিল তারা সবাই খতম হয়ে গেছে।’ 
প্রথম অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ায় আমরা সবাই আনন্দে আত্মহারা। মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক খান বলেন, এরপর থেকে টানা যুদ্ধ চলছিল। একপর্যায়ে আমরা আনন্দবার্তা পেলাম পাকিস্তানি মিলিটারি যুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে তারা আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে আমরা খবর পেলাম রেসকোর্স ময়দানে ৯৭ হাজার পাকিস্তানি আর্মি মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

সঙ্গে সঙ্গে আমরা গ্রামের আপামর জনগণের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে বিজয় উৎসবে মেতে উঠলাম। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পরস্পরের সঙ্গে আলিঙ্গনে আনন্দে কেঁদে ফেললাম। স্টেনগানের গুলি ফুটিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলাম। কি যে আনন্দ, কোনোভাবেই তা বলে বোঝাতে পারব না। হয়ত এমন আনন্দের মুহূর্ত জীবনে কোনোদিন আর আসবে না। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক খান যুদ্ধদিনের সে সব কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় বসবাস করছেন এবং দেশের একজন স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন। ইতোমধ্যে ৪০টি বই প্রকাশিত হয়েছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার লেখা বই যারা যুদ্ধ করেছিল, আমার মুক্তিযুদ্ধ, জয়বাংলা আমার নাম, কিছু গেরিলা ইত্যাদি।

×