ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

ডিনামাইট দিয়ে পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দেই

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ১৩ মার্চ ২০২৩

ডিনামাইট দিয়ে পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দেই

ডা. আরশাদ সায়ীদ

ভারি অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র কয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে নেমে তাদের পরাভূত করেছে বাংলার তরুণ দামাল ছেলেরা। তাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বগুড়ার ডা. আরশাদ সায়ীদ। কখনো গেরিলা যুদ্ধ, কখনো আকস্মিক হানাদারদের কবলে পড়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তায় সম্মুখ সমরে বিজয়ী হয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট বগুড়ায় হানাদার পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকাররা যখন পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস পালনের প্রস্তুতি নেয়, তার আগের রাতেই আরশাদ সায়ীদ তার দল নিয়ে গেরিলা কায়দায় বোমা মেরে উড়িয়ে দেন পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর ছাউনি ও পাওয়ার স্টেশন। হতাহত হয় পাকিস্তানি সেনা।

হতবিহ্বল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর স্বাধীনতা দিবস পালন ভ-ুল হয়ে যায়। তারা দিশেহারা হয়ে ছুটতে থাকে। এটাই ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আরশাদ সায়ীদের বগুড়ায় প্রথম অপারেশন।
ডা. আরশাদ সায়ীদের বয়স এখন ৭০ বছর পেরিয়েছে। গৌরবময় অধ্যায়ের স্মৃতিকথায় বললেন, ১৯৭১ সালের মার্চে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে তারা কয়েক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ২৫ মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ও কয়েক সহকর্মী সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাটের কুরমাইল ক্যাম্পে পৌঁছেন।

৭ নম্বর সেক্টরের ট্রানজিট এই ক্যাম্পে তিনি নাম লেখান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর কমান্ডিং অফিসার মেজর নাজমুল হক (শহীদ হয়েছেন) মেডিক্যাল স্টুডেন্টের পরিচিতি পেয়ে তাকে তরঙ্গপুর ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনিসহ তিনজনকে প্রথম বিশেষ গেরিলা কমান্ডোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের সময়ই মেজর নাজমুল হক জানান, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করছে। সেই তালিকায় তাদের নাম ওঠে। তিনি বলেন, এটাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ভলিউম।

সেক্টর কমান্ডার নাজমুল মুক্তিযুদ্ধের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে ৭নং সেক্টরে তার স্থলাভিষক্ত হন লেফট্যানেন্ট কর্নেল নুরুজ্জামান। ভারতের তরঙ্গপুর ক্যাম্পে গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষ করে হানাদার পাকিস্তানি সেনা কবলিত বগুড়ার কয়েকটি এলাকায় কমান্ডো অভিযানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আস্তানা তছনছ করে দেন। একের পর এক অপারেশন চালান। 
’৭১-এর আগস্ট মাসে বগুড়ার সাবগ্রামে একটি সফল গেরিলা অপারেশনের পর গ্রুপ কমান্ডার আহসান হাবিব ওয়ালেস সিদ্ধান্ত নেন বড় একটি সফল অপারেশনের। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। নিজেদের দেশ বাংলাদেশ দখলে রাখা হানাদার পাকিস্তানিরা যেন তাদের স্বাধীনতা দিবস এই দেশে পালন করতে না পারে তার পরিকল্পনা করা হয়। এই অপারেশনের দায়িত্ব বর্তায় আরশাদ সায়ীদের ওপর। ঠিক করা হয় বগুড়া পাওয়ার হাউস থেকে যে মেইন লাইন বের হয়ে গেছে বিস্ফোরক দিয়ে তা উড়িয়ে দিলে একদিকে বগুড়া অন্ধকার থাকবে, আরেকদিকে পাক সেনাসহ লোকজন জানবে মুক্তিবাহিনী শহরে ঢুকেছে। ওদের ১৪ আগস্টের অনুষ্ঠান পণ্ড হবে।

অপারেশনটি অনেক বিপজ্জনক। পাওয়ার হাউসে পাক সেনাদের আছে শক্তিশালী পাহারা। আছে সার্চলাইট। সামনে ট্যাঙ্ক। পরিকল্পনা অনুযায়ী, গ্রুপ করে আরশাদ, নোবেল ও সাইফুল বাজারের চটের ব্যাগের ভেতরে দরজায় লাগানো পুডিংয়ের মতো বিস্ফোরক রেখে ওপরে শাক-সবজি দিয়ে ঢেকে রং মিস্ত্রির ছদ্মবেশে পথে নামেন। ব্যাগে আরও ছিল সামান্য কাপড়চোপড়, যা দিয়ে কৌশলে ঢেকে দেওয়া হয় ডিনামাইট ও ডেটোনেটর। গেরিলা অপারেশনের কায়দায় কোমরে গামছা বেঁধে রাখা হলো দুটি করে গ্রেনেড। 
শুরু হলো অপারেশন পাওয়ার হাউস। অনেকটা হাঁটা পথ পাড়ি দিয়ে রাত আটটার দিকে বগুড়ায় পৌঁছেন তারা। শহরের ভেতরের এবড়ো খেবড়ো পথ পেরিয়ে পাওয়ার হাউসের কাছাকাছি অবস্থানে গিয়ে দেখা গেল হানাদার পাকিস্তানি সেনার একটি কনভয় পার হচ্ছে। রাতের মেঘলা আকাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ টর্চের আলোয় চমকে ওঠে সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পাওয়া গেল সামনে-পেছনে ১০/১২ জন পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী। আরশাদ আধোভাঙা উর্দু জানতেন।

মিলিশিয়াদের প্রশ্নে ভাঙা উর্দুতে বললেন, তারা রংমিস্ত্রি। কাজ শেষে ফিরতে দেরি হয়েছে। বাজারের ব্যাগ দেখে ওরা মনে করল রংমিস্ত্রিই হবে। পাক সেনার কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ বসতে দিল। ওরা তিনজন (আরশাদ, নোবেল ও সাইফুল) ভাবল, মারা তো পড়েছেই, বুদ্ধিমত্তায় শেষ চেষ্টা করে দেখা হোক। ওদের বসবার অবস্থানটি ছিল পাওয়ার গ্রিডের মূল তারের কাছেই। কেবিন বক্স সেখানে।

কোনো দেরি না করেই এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বের হওয়ার পথ দেখে নিয়েই সার্চলাইটের কন্ট্রোল প্যানেলে সরাসরি গ্রেনেড চার্জ করেন। কারও কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বের হওয়ার পথ দিয়ে দৌড়ে পাশের ডোবার মধ্যে যান। ক্রলিং করে এগোবার সময়ই গোঙানির শব্দ পেয়ে তারা বুঝতে পারেন অপারেশন সফল হয়েছে। বোমার আঘাতে ছাউনির ভেতরে থাকা হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের কেউ বাঁচতে পারেনি। যে পাক মিলিশিয়ারা বাইরে ছিল, তারা অন্ধকারে ছোটাছুটি করতে থাকে। এরপর শহরের দক্ষিণ দিক থেকে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটি কনভয় জামিলনগরের দিকে যাওয়ার সময় ওঁৎ পেতে থাকা গেরিলা যোদ্ধারা পথে দ্রুত মাইন বসিয়ে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেই কনভয় উড়িয়ে দেন। রাতের এই অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনাদের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান আর হয়নি।

এর ক’দিন পর শহরের চেলাপাড়া এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ অতিক্রমের সময় ডেটোনেটর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে সংগ্রহ করা হয় আধুনিক অস্ত্র। এই অপারেশন চলে দিনের বেলায়। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের এমন বীরত্বে এলাকার মানুষ এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয় যে, তারা বুঝেই ফেলে দেশ মুক্ত হতে আর দেরি নেই।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর দেশ স্বাধীন হলে আরশাদ সায়ীদ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ফিরে ডাক্তারি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৭৬ সালে এমবিবিএস পাস করার পর চিকিৎসা সেবায় যোগ দেন। বগুড়ায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমান প্রজন্মকে ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন’ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে বিজয়ের গল্প বলে শিশু মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেঁথে দেন।

×