ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

৪০ হাজার নলকূপে জরুরি ব্যবস্থা না নিলে  বিপদের আশঙ্কা 

মুন্সীগঞ্জে নলকূপে আর্সেনিক

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ১১ মার্চ ২০২৩

মুন্সীগঞ্জে নলকূপে আর্সেনিক

আর্সেনিকযুক্ত টিউবওয়েল চিহ্নিত করা হচ্ছে

মুন্সীগঞ্জের ৩৯ হাজার ৮৯৯টি নলকূপে আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছে। জেলাজুড়ে আর্সেনিকের এই ভয়ংকর চিত্র আঁতকে ওঠার মতো। তার চেয়ে বেশি শঙ্কার বিষয় নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়ার পরও অনেক পরিবার এখনো লাল চিহ্নিত নলকূপের পানি পান করছে। মুন্সীগঞ্জের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবীর জনকণ্ঠকে জানান, গজারিয়া উপজেলার ভবেরচরে তিনি সরেজমিন পরিদর্শন করে এমন চিত্র পেয়েছেন। 
জেলার বিভিন্ন স্থানেও এমন চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার অনেক বাড়িতে আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ না থাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি প্রাপ্তিতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। তবে জনস্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, তারা গভীর নলকূপ সরবরাহ করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। তাই জরুরি ভিত্তিতে মুন্সীগঞ্জে পর্যাপ্ত গভীর নলকূপ সরবরাহ করা প্রয়োজন বলে গবেষকরা মনে করছেন। 
জেলায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত  ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৪টি টিউবওয়েল পরীক্ষা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনো প্রায় ৫০ হাজার টিউবওয়েলের পরীক্ষা বাকি। তারা বলছেন, জেলায় ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৮৫টি আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল সবুজ চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে বেসরকারি নলকূপই বেশি । জেলায় সরকারি ৩৮ হাজার ২৬৭টি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে চালু ৩৭ হাজার ৮৮৩ নলকূপ। আর সরকারি অকেজো নলকূপের সংখ্যা ৩শ’ ৮৪টি।
এর মধ্যে সরকারি অগভীর মোট ১৪ হাজার ৬৩টির মধ্যে অকেজো ২৯৫টি, গভীর নলকূপ সাবমারসিবল সরকারি ২১ হাজার ৭৫৩টি নলকূপের মধ্যে অকেজো ৫৯টি। অগভীর সরকারি ১৩ নলকূপের সবগুলোই অকেজো। তবে সরকারি তারা গভীর সাবমারসিবল ২ হাজার ৪০৬টির সবই সচল। কিন্তু ৩২টি সরকারি রিংওয়েল টিউবওয়েলের সবই অকেজো। সরেজমিন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, শ্রীনগর, সিরাজদিখান, টঙ্গীবাড়ি ও সদর উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে নলকূপের পানি ব্যবহার না করতে লাল চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিরাপদ পানি সহজলভ্য না হওয়ায় এ নিষেধ মানছেন না অনেক বাসিন্দা।
অনেকেই তাদের নলকূপে আর্সেনিকের সমস্যার বিষয়টি সমাধান হিসেবে নতুন করে সরকারিভাবে নলকূপ দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। নিজ উদ্যোগে অনেকে নলকূল স্থাপন করে পরে দেখেন, ওই নলকূপের পানিতেও আর্সেনিক রয়েছে। এতে করে সবাই এক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি স্থানীয়দের। লৌহজংয়ের কারপাসা গ্রামে যেসব নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে, সেগুলোর পানি ব্যবহার না করার নির্দেশনা মানছেন না অনেকেই। কেননা, স্থানভেদে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপের দূরত্ব বা নিরাপদ পানি সংগ্রহের বিষয়টি অনেকের জন্য জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া কেউ কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের পানিই ব্যবহার করছেন। এতে করে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের ভয়াবহতা তুলে ধরে সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুরুল আলম জনকণ্ঠকে জানান, দীর্ঘ সময় ধরে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে আর্সেনিকোসিস রোগ দেখা দেয়। মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পানের কারণে হাত ও পায়ের তালুতে ছোট ছোট শক্ত গুটির মতো দেখা দিতে পারে। গায়ের চামড়া মোটা ও খসখসে হয়ে যায়। চামড়া, মূত্রথলি ও ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিডনি ও লিভার অকেজো হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। সরকারি হিসাব মতে, মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় ১ হাজার ৫৩৯ নলকূপে আর্সেনিক চিহ্নিত করা হয়েছে। গজারিয়া উপজেলায় ৫ হাজার ২০৯টি নলকূপে আর্সেনিক। টঙ্গীবাড়ি উপজেলায় ৫ হাজার ৬শ’ ৭২ নলকূপে আর্সেনিক ধরা পড়েছে। লৌহজংয়ে ১০ হাজার ৭৯৩ নলকূপে আর্সেনিক চিহ্নিত হয়েছে। শ্রীনগর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৯শ’ ৮৭ নলকূপে এবং সিরাজদিখানে ৪ হাজার ৭ শ’ নলকূপে আর্সেনিক ধরা পড়েছে। ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা জরিপে এই ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। 
কিন্তু প্রকল্পের অর্থের অভাবে নাকি পরীক্ষার আওতার বাইরের টিউবওয়েলের পরীক্ষা করা যায়নি। তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, যে কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও নলকূপের পানি নিয়ে এসে উপজেলা বা জেলা অফিসে বিনামূল্যে পরীক্ষা করতে পারবেন। অফিসগুলোতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অফিসগুলোতে পর্যাপ্ত কিট রাখা হয়েছে। 
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন বিভিন্ন নলকূপ পরিদর্শন শেষে বলেন, অনেক নলকূপেই আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। অগভীর প্রায় সব টিউবওয়েলেই আর্সেনিক। আর এখন পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ায়ও সমস্যা তৈরি হয়েছে। জরুরি ব্যবস্থা না হলে বড় বিপদের আশঙ্কা করে পরিবেশ বিজ্ঞানী আরিফুর রহমান জানান, আর্সেনিক থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় সচেতনতাসহ সুপেয় পানি সহজ্যলভ্য করা জরুরি। কোনোভাবেই যাতে লাল চিহ্নিত নলকূপের পানি পান থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকতে হবে। 
মুন্সীগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান জানান, জেলার নলকূপগুলোতে ভয়াবহ রকমের আর্সেনিক সনাক্ত হওয়ার পর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আরও বড় ধরনের তৎপরতা প্রয়োজন ছিল। তারা এক রকম ঘুমিয়ে আছেন। এখনই এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে জেলাবাসীকে বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষার দাবি জানান। 

×