ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

দুইদিন একরাত গুলিবিনিময়ের পর পাকসেনারা পালিয়ে যায়

এইচএম মোনায়েম খান, রায়গঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ৪ মার্চ ২০২৩

দুইদিন একরাত গুলিবিনিময়ের পর পাকসেনারা পালিয়ে যায়

আব্দুল খালেক মন্টু

সিরাজগঞ্জের উত্তরে যমুনার বাঁধের পশ্চিম পাশে ভাটপিয়ার স্কুল। সেখানে পাকিমিলিশিয়া ও রাজাকাররা অবস্থান নিয়েছে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পাকিসেনা ও রাজাকারদের শক্ত ক্যাম্প ভাটপিয়ার স্কুলে আক্রমণ করি। অপারেশনের পূর্বে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়। রাত ১১টা হতে দুটা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। আশরাফসহ আমাদের পজিশন ছিল বাঁধের পূর্বপাশে, খুবই রিস্কি পজিশন। গোলাগুলির মধ্যে বাঁধে ওঠানামা করা কঠিন।

তাছাড়া সিরাজগঞ্জ ও কাজীপুর থেকে পাকিসেনাদের আগমন ঘটাও অস্বাভাবিক ছিল না। প্রচ- চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পের পতন ঘটে। অনেক রাজাকারসহ সাতজন পাকিমিলিশিয়া নিহত হয়। বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। ওই যুদ্ধে আমিনুল চৌধুরী ও মোতালেব গুরুতর আহত হন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। ধরাধরি করে ভেওয়ামারা গ্রামে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক মন্টু।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সিরাজগঞ্জ শহরের উত্তরে কাজীপুর থানায় আমাদের বিশাল দলটির গাইড ছিলেন হাসান আলী। এখন তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। অক্টোবরের শেষ দিকে কাজীপুরের বরইতলা গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য ও ইউপি চেয়ারম্যান ইমান আলীর বাড়ি পোড়ানো হয়। সেদিন ওই গ্রামেই আমাদের শেল্টার। দুপুরে আমরা ক’জন জাল দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরি। রাতে আলাউদ্দিন, আশরাফসহ আমরা ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা মোজামের দল থেকে ভাগ হয়ে রায়গঞ্জের দিকে যাওয়ার পথে পার্শ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নেই।

পরদিন সকাল আটটার দিকে হানাদাররা ইমান আলীর গাইডে বরইতলা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। উভয়পক্ষের মধ্যে বেলা ১১টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। পাশের গ্রাম থেকে আমরাও গুলিবর্ষণ করি। ওই যুদ্ধে রবিলাল নামে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিবাহিনীর বিরাট দলটির ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ার আশঙ্কায় মোজাম ভাই, এছাক ভাই, আমিনুল চৌধুরী দলবল নিয়ে যমুনার চর এলাকায় চলে যান। অবস্থা বুঝতে পেরে আমরাও রায়গঞ্জের দিকে চলে আসি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মন্টু বলেন, ১৯৭১ সালের নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ। আমরা ধানঘড়ার আশপাশেই ছিলাম। সেদিন ছিল হাটবার। তারিখ ২১ নভেম্বর, রবিবার। সন্ধ্যায় শুনতে পাই হান্নান সিপাইকে হাট থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে গেছেন। আকাশের দিকে স্টেনগানের ব্রাশফায়ার করে জনগণকে আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত করে রইচ উদ্দিন জয়নাল ও আব্দুল মান্নান বাদশাহ (পরে কবি সমুদ্রগুপ্ত) তাকে ধরে নিয়ে যান। হান্নান সিপাইকে আমি আগে থেকেই চিনতাম।

যুদ্ধের প্রথম ভাগে সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই ছিল। অনেক খবরাখবর আমাদের কাছে পৌঁছে দিত। পরে সম্ভবত পরিস্থিতির চাপে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হয়ে যায়। রাজাকারদের প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে। শেষ পর্যায়ে জয়নালরা দেশে ফিরে বিষয়টা জানেন। তাই তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। সন্ধ্যার অনেক পর লক্ষ্মীকোলায় হান্নান সিপাইসহ জয়নালদের দেখা পাই। মোস্তফা ও আমাকে দেখে হান্নান সেপাই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। তাকে বাঁচানোর চেষ্টাও করি।

হান্নান সিপাইও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কাজ হয় না। রাত একটু গভীর হলে আলাউদ্দিনের দলের মোমিনের সঙ্গে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা নতুনদহের মধ্যে নামিয়ে তাকে মেরে ফেলেন।
যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, আলাউদ্দিনের কমান্ডে সে রাতেই রায়গঞ্জ থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। আমার বিবেচনায় সে রাতে থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। হান্নান সিপাইকে ধরার পরে থানায় অবস্থানরত পুলিশ ও মিলিশিয়ারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই সিরাজগঞ্জ থেকে অতিরিক্ত ফোর্স নিয়ে আসে এবং যুদ্ধের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

ওই রাতে তারা বাংকারে অবস্থান নেয়। আমার নিষেধ উপেক্ষা করে হুজুগে সে রাতে থানা আক্রমণ করা হয়। প্রায় দু’ঘণ্টা উভয়পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। আমরা পিছু হটে সবাই চলে আসি। কিন্তু আহম্মদ ও আশরাফকে খুঁজে পাই না। পরে শুনি আহম্মদ শহীদ হয়েছেন। আহম্মদ আমার সহযোদ্ধা। ভদ্র-নম্র ও শিক্ষিত যুবক। রায়গঞ্জ যুদ্ধের পূর্বদিন একটি নতুন জামা তৈরি করান। শহীদ হওয়ার সময় ওই জামাটি তার গায়ে ছিল। একজন সম্ভাবনাময় যুবকের অমূল্য প্রাণ অকালে ঝরে যায়। আশরাফকে পরের দিন করিলাবাড়ীতে পাওয়া যায়।

কানে খাটো হওয়ায় পিছু হটার সংকেত বুঝতে পারেননি তিনি। অনেক পরে একা একা করিলাবাড়ী যান। শুনেছি শত্রুপক্ষীয় অনেকে হতাহত হয়েছে। যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক হানাদার পাকিসেনা, তাদের দোসর রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পাগলের মতো আচরণ শুরু করে। জামায়াত নেতা বক্কার মৌলভী ও মফিজ মাওলানার কুমন্ত্রণা ও কমান্ডে পরদিন ২২ নভেম্বর পাকিসেনা ও রাজাকাররা ধানঘড়া ও আশপাশের কয়েকটি গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং ১৯ জন নিরীহ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে।

ধানঘড়ায় অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একজনের মিসফায়ার এজন্য দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। আমরা তখন কুরিগাঁতীর উত্তরে জোলাগাঁতীর কাছে এক বটগাছের নিচে বসা। রাতে এলাকায় এসে জানলাম আমাদের বাড়ি মনে করে আবুলের বাড়ি পুড়িয়েছে। আমাদের বাড়ি যেমন রাস্তার ধারে ও সামনে পুকুর, আবুলের বাড়িও রাস্তার ধারে ও সামনে পুকুর। তাছাড়া আমাদের বাড়ি না পোড়ানোর আরও একটি কারণ থাকতে পারে।

হযরত বগুড়া থেকে ফিরে রটিয়েছিল আমি মারা গেছি। ইতোপূর্বে পাকিসেনা ও রাজাকাররা তিনবার আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। একজন রাজাকার কমান্ডার ভয় দেখিয়ে আমার বাবার কাছ থেকে মাঝে মাঝে টাকা নিত। সে পাকিসেনা ও অন্যান্য রাজাকারকে সম্ভবত বুঝিয়েছে আমি মারা গেছি। এ কারণে হামলা চালানো সত্ত্বেও তেমন কোনো ক্ষতি করেনি।
হযরতের ওই মিথ্যা রটনায় আমার উপকারই হয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে জানি ওইদিন যারা শহীদ হয়েছেন তারা হলেন, মহেশপুরের নূর মোহাম্মদ (পিতা-ওমেদ আলী), গুনি মিয়া (পিতা- মোহাম্মদ হোসেন), আব্দুস সালাম (পিতা- ইয়াকুব আলী), আজাহার আলী (পিতা- বাদু শেখ), মহাদেব সাহা (পিতা- মঙ্গল চন্দ্র সাহা), নীলমণি তালুকদার (পিতা- জলধর তালুকদার), নগেন্দ্রনাথ মোদক (পিতা-দুর্গাচরণ মোদক), জয়নাল আবেদীন (পিতা- কাঞ্চিয়া শেখ), ধানঘড়ার আবুল কালাম (পিতা- রমজান আলী), নিখিল চন্দ্র পাল, বুধা পাল (পিতা- রমন চন্দ্র পাল), বানু পাল (পিতা- কেদার পাল), পুসনা পাল (পিতা-অপুচ্ছা পাল), জাবেদ আলী (পিতা- শুকুর মাহমুদ), আকবর আলী (পিতা- দোস্ত মাহমুদ), লক্ষ্মীকোলার মোহাম্মদ আলী (পিতা- গোমর আলী), আব্দুল জলিল (পিতা- রসুল উল্লাহ), চাঁনপুরের আন্ধাইরা শেখ (পিতা- মাজু শেখ), আস্তাহার আলী।
সিরাজগঞ্জ শহরের কাছাকাছি শৈলাবাড়ীতে পাকিসেনাদের শক্ত একটা ক্যাম্প ছিল। ভারত থেকে সদ্য প্রবেশ করা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল মিলে শৈলাবাড়ী ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। সদ্য প্রবেশ করা দলগুলোর যুদ্ধের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। পূর্বে কোনো যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়নি। শেষ সুযোগ হিসেবে ডিসেম্বরের ১২ তারিখ শৈলাবাড়ী ক্যাম্প আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। পাকিসেনারা এমনিতেই পালানোর পথ খুঁজছিল।

তার ওপর আক্রান্ত হওয়ায় তারা বেসামাল হয়ে পড়ে। মরিয়া হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ভারি অস্ত্রের গুলিবর্ষণ করতে থাকে। প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা না থাকায় ওই যুদ্ধে নয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ভারত থেকে নতুন প্রবেশ করা দলগুলোর সঙ্গে মোজাম, আলাউদ্দিনসহ আমরা অনেকেই ছিলাম। দুইদিন একরাত গুলিবিনিময়ের পর সুযোগ বুঝে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। সিরাজগঞ্জ শহর মুক্ত হয় ১৪ ডিসেম্বর। বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে শহরে প্রবেশ করেন।
শৈলাবাড়ী যুদ্ধে শহীদ হন সোহরাব হোসেন, আহসান হাবিব, তোজাম্মেল, মকবুল হোসেন, কালু, আব্দুস সামাদ, সুজাবত, সফর, রাজ্জাক।

×