
বসন্তের সাজে উদ্যাপন
প্রকৃতির কবি শেলীর একটি কবিতায় আছে ‘ইফ উইন্টার কামস ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড।’ বাংলায় ভাবার্থ- শীত যদি আসে বসন্ত কি খুব দূরে। বিশ^জুড়ে বসন্তের রূপ একই। এই বসন্তকাল নিয়ে কতই না মাতামাতি। দেশে পৌষ সংক্রান্তির পরই বসন্তের ফুরফুরে মেজাজ চলে আসে। বাংলার প্রবাদের কথা- মাঘের শীতে বাঘ পালায়। অতীতের সেই বাঘ পালানো শীত আর নেই।
বাঘেরা এখন বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। রোদ পোহায়। মাঘের শেষে বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুন শুরু হলে বাঘও ফাল্গুনে মেতে ওঠে। বাঘ শুমারির জন্য বৃক্ষে এঁটে দেওয়া ক্যামেরাও ভেঙে ফেলে। বাংলার চিরায়ত বসন্ত মানুষ ও প্রাণিকুলে এনে দেয় অপার মধুময়তা।
এই মধুময়তা নারী-পুরুষের অবস্থান একই বৃন্তে। বৃত্তের বাইরে কেউ যেতে পারে না। মনের দুয়ারে টোকা দেয় প্রেমময় উপাখ্যান। প্রকৃতির সাজে মানুষ ও প্রাণিকুল সাজে নতুন রূপে। বসন্ত বরণে যেমন আছে ফুল। বসন্ত বিলাপে আছে কথামালা। যে কথা ফুরাতে চায় না। বসন্ত বেলার প্রকৃতিও ভিন্ন তালে সুর বাজায়। ক’দিন আগের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে মেঘ ভেঙে মিষ্টি রোদ ওঠে। এই রোদ কখনো চরে উঠে ফের থেমে যায়। মৃদু মন্দ বাতাস বইতে থাকে। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঘূর্ণিপাকে পথের ধূলি উড়িয়ে জানান দেয় চৈত্রের আগমনী বারতা।
বাংলার প্রকৃতিতে ফাল্গুন ও চৈত্র বসন্তকাল। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে অন্যান্য জোড়া মাসের চেয়ে ফাল্গুন-চৈত্র কিছুটা আলাদা। মনে হবে যমজ মাস। টুইন বেবি একজনকে আঘাত করলে আরেকজন কেঁদে ওঠে। ঋতুবৈচিত্র্যের বসন্তে ফাল্গুনের হাওয়া জমে রাখে চৈত্রের জন্য। ফাল্গুনের জ্যোৎ¯œায় পূর্ণিমা রাতে আকাশের জ¦লে ওঠা মিটিমিটি তারার নাচন দেখা যায়। এই নাচন নিসর্গ হয়ে ওঠে যখন কোনো জলাশয়ে প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে। মনে হবে প্রকৃতিতে বসন্ত বিলাপে চাঁদ নাচছে তারা নাচছে।
বসন্ত-বাতাস দোলা দেয় হৃদয় থেকে হৃদয়ে। মাঘের শেষের দিনে এই মন জানান দেয় ফাল্গুনের দুয়ারে টোকা দিয়ে। পরদিনের সকালে সে আরেক রূপ। দেশজুড়ে কি শহর কি গ্রাম ফাল্গুন নিয়ে কতই না আয়োজন। এই দিনে মেয়েরা লালপেরে হলুদ শাড়ি পরে খোঁপায় গাঁদা ও গোলাপ এঁটে বসন্তকে বরণ করে নেয়। হালে মাথায় নানা ধরনের ছোট ছোট ফুলের ডালা সাজিয়ে দেয়। বসন্ত বেলা যে ফাল্গুনের রোমান্টিকতা তা মনে করিয়ে দেয়। জীবনের বসন্ত বেলায় যাই থাক প্রকৃতির বসন্ত বেলায় শুরু হয়ে যায় জুটি খোঁজা। বসন্ত বেলা শুরু হলেই মেলাগুলো সব এগিয়ে আসে।
কিছু মেলা প্রাণের স্পন্দনে অদৃশ্য। হৃদয় উৎসারিত হয়ে আসে কপোত কপোতির মধ্যে। কিছু মেলা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে কখনো গ্রামের কোন পাথারে। কখনো শহরের কোনো খোলা জয়গায় অথবা কোনো পার্কে। মেলাগুলোর কোনো নাম নেই। যখন যে যে নামে ডাকে। অন্যান্য মেলায় যেমন বাহারি জৌলুস থাকে বসন্তের এই মেলার জৌলুস প্রেমিক হৃদয়ে। মেলাকে ঘিরে সুর বেজে ওঠে ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইলো না কেহ।’ হৃদয়ের কথা বলার মানুষটি যে আশপাশেই আছে তা খুঁজে দেখা হয় না। বসন্তের মেলার বৈশিষ্ট্য এমনই।
একদা বসন্তের গ্রামের চিত্র ছিল মধুর। তবে সেদিনের গ্রামের পটে আঁকা ছবি আজ খুঁজে পাওয়া যায় না। অতীতের ফাল্গুন ছিল মানুষে মানুষে মেল বন্ধনের সে মহা আয়োজন। বসন্তের শুরুতে গৃহস্থ বাড়িতে থাকত নানা আয়োজন। এই দিন গাঁয়ের বধূরা আটপৌরে (আট প্রহরের) শাড়ি পরে গীত গেয়ে বরণ করত বসন্ত। এক বাড়ির বউয়ের গীত গাওয়া দেখে আরেক বাড়ির বউ যোগ দিত। এভাবে পুরো গ্রাম নেচে উঠত বসন্তের অন্য রকম নাচনে। বাড়ির কর্তা কৃষক ও গৃহস্থ শামিল হতো কোনো গাছতলায়। সেখানে জীবনের কথামালার ডালায় কতই না কথা সাজানো থাকতে। সকালের মিষ্টি রোদের পর দুপুর গড়াতেই বিকেল ও গোধূলি বেলার রূপ ফুটে উঠত পশ্চিম আকাশে।
তারপর দূর আকাশের ক্লান্ত পাখি যেমন নীড়ে ফেরে। গৃহস্থ ও কিষান বাড়ির বউ কুলা-ডালা হাতে কোনো কিছু ঘর গেরস্থালি শুরু করে। তারপর রাতের প্রথম প্রহরে ঘর গেরস্থালি কাজ সেরে আঙিনায় চুলার ধারে বসে আরেক পশলা গল্পগুজব। এই পালায় পুরুষরা বাদ যায় না। তারাও উঠানে বসে প্রকৃতির আলো-আঁধারি খেলায় গপসপে মেতে ওঠে। বসন্ত বেলার প্রাণের স্পন্দনের এই চিত্র আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রবীণরা কিছুটা ধরে রেখেছেন। তবে প্রজন্মের কাছে তাও হার মেনেছে। প্রজন্মের তরুণরা বসন্তকে উদ্যাপন করে ভিন্ন ধারায়। হালে গ্রামও অনেক উন্নত হয়েছে। পাকা সড়কের ধারে বিদ্যুতের খুঁটির আলোতে প্রকৃতির ¯িœগ্ধ আলো মৃদু জ্যোৎ¯œা মিলিয়ে গেছে। এমন আলোয় হুঁতোম পেঁচা গাছের কোটরে থেকে প্রহর গোনার ডাক দিতেও ভুল করে। তবে বসন্ত বেলার সবচেয়ে মধুময়তা হলো- কোকিল ঠিক সময়ই কুহুকুহু ডাক দিয়ে দিনের প্রহরগুলো জানিয়ে দেয়।
কোকিলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামের কোনো উঁচু বৃক্ষের শাখায় বসে বাংলার বউ কথা কও পাখি ডাক দিয়ে বাড়িতে কুটুম আসার খবর দেয়। এই কুটুম যে দূরের কোনো গাঁয়ের বা কোনো এলাকার হবে তাও নয়। কোনো বাড়ি থেকে সেজেগুজে কোনো নববধূও আসতে পারে। যে খবর ওই বাড়ির লোকজন জানতে পারেনি। বউ কথা কও পাখি তা জানিয়ে দিয়েছে সুর তুলে।
বসন্তে বিরহ আছে, আছে বিলাপও। প্রকৃতির সঙ্গে মিলে মিশে সব যেন এক হয়ে গেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সুরে ‘আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে, কত পাখি গায়, কত বাঁশি বাজে।’ ফুলের সঙ্গে গভীর মমত্ব ভ্রমরের। আর বৃক্ষের সঙ্গে অপার ভালোবাসা পাখিদের। প্রাণিকুলের এই মমত্ব ও ভালোবাসায় প্রকৃতির বসন্তের রূপে প্রবেশ করেছে মানুষের মধ্যে। যেখানে সুরের ঢেউ নদীর ঢেউয়ের মতো বয়ে গিয়ে খেলা করে এক হৃদয় থেকে আরেক হৃদয়ে। বাংলায় এমনি ভাবে বসন্ত আসে বারবার।
সমুদ্র হক, বগুড়া