ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

দুটি ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেই

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:০০, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দুটি ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেই

সাইফুল ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অহংকার। অনেক ত্যাগ আর সংগ্রামে অর্জিত হয় বাঙালির স্বাধীনতা। অনেক ত্যাগ স্বীকার করে অমূল্য স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এমনই একজন সিরাজগঞ্জের সাইফুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা স্মরণ হলেই গর্বে বুকটা ভরে ওঠে এই বীর সেনানীর।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেপ্টেম্বর মাসে গোবিন্দগঞ্জ-গাইবন্ধা সড়কের দুটি কাঠের ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এ খবর পেয়ে পাকিসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর-আলশামস বাহিনী গাইবান্ধায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্ব অনুভব করে। পাকি হায়নার দল নড়েচড়ে বসে। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে হানাদাররা। এই হামলার ঠিক দুদিন পর গাইবান্ধা শহর থেকে দূরের একটি গ্রামে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে নিরীহ জনগণের ওপর বর্বর হামলা চালায় পাকি বাহিনী।

এ খবর পার্শ্ববর্তী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ছাউনিতে পৌঁছালে ৬০-৬৫ জনের একটি দল গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লেøাগান দিয়ে পাকি হায়নার দলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। প্রথমে গোলাগুলি হয়। এলাকার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলেমিশে প্রতিরোধে অংশ নেন। সমস্বরে ‘জয় বাংলা’ স্লেøাগান উচ্চারিত হতে থাকে। স্লেøাগানের আওয়াজ  আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে এবং মনে হয় হাজারও মানুষের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। যুদ্ধ নয়, ‘জয় বাংলা’ স্লেøাগানের আওয়াজেই পাকি হায়নার দল গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পাকি হায়নার দল পাবনা শহরের দখল নেয়। এরপর কোথায় যাব, কী করব এমনটাই ভাবছিলেন। একপর্যায়ে গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ মহুকুমার সদর থানার গজারিয়া গ্রামে বাব-মায়ের কাছে ফিরে আসি। মুক্তিযুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রওনা হই ভারতের পথে। কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায় দেশের মুক্তাঞ্চল কুড়িগ্রামের রৌমারীতে পৌঁছাই। সেখানে সাতদিনের একটি প্রশিক্ষণ হয়। প্রশিক্ষণ দেন তৎকালীন ছাত্রনেতা ইসমাইল হোসেন।

অভ্যন্তরীণ সড়কের ব্রিজ-কালভার্টসহ নানা স্থাপনা বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার কৌশল প্রশিক্ষণ নিয়ে অপেক্ষা করি ভারতে যাবার জন্য। এরমধ্যে গাইবান্ধা থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা এলেন তাদের এলাকায় ব্রিজ-কালভার্ট উড়িয়ে দেবার জনবল সহযোগিতার জন্য। প্রশিক্ষক ইসমাইল হোসেনের নির্দেশে আমি নিজে এবং সহযোদ্ধা হাবিবকে নিয়ে রওনা হই গাইবান্ধার উদ্দেশে। দিন তারিখ মনে নেই। তবে মনে পড়ে তখন ছিল সেপ্টেম্বর মাস। এলাকার নামও জানি না। গাইবান্ধায় গিয়ে প্রথমেই গোবিন্দগঞ্জ-গাইবান্ধা সড়কের দুটি কাঠের ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এটাই মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রথম সম্মুখযুদ্ধ।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, এরপর গাইবান্ধা ছেড়ে আবারও রৌমারীর পথে রওনা হই। সেখান থেকে ভারতের শিলিগুড়ির পাথরঘাটা ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ নেই। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর মতিলাল চক্রবর্তী (এমএল চক্রবর্তী)। প্রশিক্ষণ শেষে বালুরঘাট সীমানা চৌকিতে চলে আসি নভেম্বরে। এরপর দিনাজপুরের বিরল সীমানা চৌকি দিয়ে দেশে ঢুকি ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে। ধীরে ধীরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, ঘোড়াঘাট হয়ে চলে আসি বগুড়ায়। এরমধ্যে পথে পথে পাকি হায়নার সঙ্গে যুদ্ধ হয়।

প্রশিক্ষণের সেই কষ্ট এবং প্রশিক্ষণ শেষের দিনগুলোর কথা মনে করতেই রণাঙ্গনের এই যোদ্ধা মনে করেন হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তাদের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয় ও খাদ্য পেয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক, দেশমাতৃকার স্বাধীনতা, বাঙালির পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার দৃঢ় প্রত্যয় তাকে  রণাঙ্গনে সাহস জুগিয়েছে বলে জানান।
১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন সাইফুল ইসলাম। তৎকালীন এমপিএ আহমেদ রফিকের হাত ধরে তিনি ছাত্রলীগে যুক্ত হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম ঢাকায় বেশ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। কিন্তু মাটির টানে সিরাজগঞ্জে ফিরে এসেছেন। বর্তমানে প্রকাশনার কাজে জড়িত। প্রতিবছর বই মেলায় তার বই প্রকাশিত হয়। তার লেখায় মুক্তিযুদ্ধ সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। তার প্রথম লেখা ছড়ার বই টিকটক প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। তার প্রকাশিত বই সংখ্যা ২৫। সিরাজগঞ্জে গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করছেন। স্ত্রী মমতাজ শিরিন এবং সন্তান সিদরাত সাকিব সাম্যকে নিয়ে তার ঘর-সংসার।

×