ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

বেশ কয়েকবার গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেই

নারায়ণ মালাকার, বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:২০, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বেশ কয়েকবার গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেই

গাজী সাইদুর রহমান

ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা গাজী সাইদুর রহমান ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা নৌকার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বেলকুচি থানা শাখার আহ্বায়ক হন। সে সময় তিনি সিরাজগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের বি কম পরীক্ষার্থী। এ সময় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রম পরিচালিত হতো সোহাগপুর সমাজ উন্নয়ন সংস্থার ভবনে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিন গাজী সাইদুর রহমান তার সাথীদের নিয়ে জনসভায় যোগ দেন। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ও নির্দেশ মোতাবেক সারাদেশের ন্যায় বেলকুচিতেও আওয়ামী লীগের সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গাজী সাইদুর রহমানের সঙ্গে স্থানীয় লাইসেন্সধারী কিছু বন্দুক ও রাইফেলের মালিক তাদের অস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম পরিষদে কাজ করতেন। কিন্তু এই প্রতিরোধ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়া দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। ইতোমধ্যেই রেল ও সড়কপথে পাক হানাদার বাহিনী সিরাজগঞ্জ শহর দখলের জন্য অগ্রসর হয়। তৎকালীন মহুকুমা প্রশাসক সামছুদ্দিনের নেতৃত্বে উল্লাপাড়ার ঘাটিনা ব্রিজের কাছে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও শেষ মুহূর্তে সিরাজগঞ্জ শহর দখল করে নেওয়ার পর সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ কাজে ব্যস্ত হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী সাইদুর রহমান বলেন, পাক সেনারা সিরাজগঞ্জ শহর দখলে নেওয়ার পর আমরা বেলকুচি আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা নিজেদের বাড়িঘর, বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের চরম অনিশ্চয়তার মাঝে রেখে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা দেই। এই যাত্রাও আমাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। চিন্তা-ভাবনা করে সড়কপথ বাদ দিয়ে নৌপথই নিরাপদ বিবেচনা করে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে বড় ছৈওয়ালা নৌকা ভাড়া করে যমুনা নদী দিয়ে কুড়িগ্রামের রৌমারীর উদ্দেশে রওনা হই।

ওই এলাকা তখন মুক্ত ও নিরাপদ ছিল। রাস্তায় চরের মধ্যে দেখা পাই এলাকার তৎকালীন এমএনএ এবং আমাদের নেতা আব্দুল মমিন তালুকদারের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের। তারা খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। আমরা তাদের আমাদের নৌকায় নিয়ে নেই। নৌপথে তখন পাকবাহিনীর গানবোট টহল দিত। নানা প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে ৫/৬ দিন পর আল্লাহপাকের মেহেরবাণীতে অসম সীমান্তের নিকটবর্তী মুক্ত এলাকা রৌমারী বন্দরে পৌঁছাই। রৌমারী বাজারে আমাদের এলাকার কিছু কাপড় ব্যবসায়ীর দোকান ও বাসা ছিল।

তাদের মধ্যে ফজল খান নামে এক ব্যবসায়ীর বাসায় আব্দুল মমিন তালুকদারের পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয় এবং স্থানীয় নেতাদের সহযোগিতায় আমরা রৌমারী নতুন বন্দর এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে অবস্থান করি। ইতোমধ্যে খবর পেয়ে সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা মোতাহার হোসেন তালুকদার এবং শহিদুল ইসলাম তালুকদার আমাদের জন্য ভারতীয় রেশনের ব্যবস্থা করে দেয়। ওই সময় সিরাজগঞ্জের সৈয়দ হায়দার আলীসহ বেশকিছু নেতা ভারতের তুরাতে অবস্থান করছিলেন।

ইতোমধ্যে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া এবং জামালপুর থেকে বেশকিছু যুবক ও ছাত্র রৌমারীতে হাজির হয়। এতে আমাদের ক্যাম্পে লোকসংখ্যা বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে আমরা রৌমারী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করি। থানার এরিয়া বেশ বড় ছিল। সিরাজগঞ্জ থেকে ইসমাইল ভাই এবং আমির হোসেন ভুলু ভাইকে ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা হতে ইচ্ছুক যুবক ছাত্রদের প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করে সেকশন, প্লাটুন এবং কোম্পানি তৈরি করে তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়।

প্রাথমিকভাবে শরীরচর্চা প্যারেড প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য গঠিত কোম্পানিগুলোকে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হতো। এরই মধ্যে রৌমারী ক্যাম্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্প হয়ে ওঠে।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আগস্টের মাঝামাঝি একটি কোম্পানি নিয়ে আমি উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য রওনা হই। আমার কোম্পানিতে তিনটি প্লাটুন এবং নয়টি সেকশন ছিল। আমি কোম্পানি নিয়ে অসমের ধুবড়ী হয়ে ভারতের রাজগঞ্জ ট্রানজিট ক্যাম্পে যাই। সেখানে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ আমাদের চূড়ান্তভাবে তালিকাভুক্ত করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য কুচবিহার, জলপাইগুড়ি এবং শিলিগুড়ী হয়ে দার্জিলিংয়ের ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক ট্রেনিং একাডেমি ‘মূর্তিক্যাম্পে’ নেওয়া হয়। ওই ক্যাম্পটি পাহাড়ের ঝর্ণাপাড়ে বিশাল ক্যাম্প ছিল।

সেখানে আলফা, ব্রেভো, চার্লি, ডেল্টা নামে বিভিন্ন উইং ছিল। আমরা চার্লি উইংয়ের অন্তর্ভুক্ত হই। আমাদের উইং কমান্ডার ছিলেন মেজর চৌহান। সহকারী কমান্ডার ছিলেন বাঙালি ক্যাপ্টেন প্রেমাংশু ওস্তাদ, যাকে ক্যাম্পের সবাই টাইগার ওস্তাদ বলতো। তার নাম অনুসারেই আমাদের কোম্পানির নাম ছিল ‘টাইগার কোম্পানি’। যে সুবাদে আমাদের এফএফ নম্বরের পূর্বে ‘টি’ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন আমার এফএফ নং-টি/১৪১। আমার কোম্পানিতে তিনজন প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন।

এই ক্যাম্পে আমাদের ৩.৩ রাইফেল, এসএলআর, এসএমজি, এলএমজি দুই ইঞ্চি মর্টার, বিস্ফোরক ও গ্রেনেড প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রায় ৬০ দিন আমরা এখানে প্রশিক্ষণ নেই। দার্জিলিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের প্রত্যেকের নামে অস্ত্র বরাদ্দ করা হয়। অস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ আমাদের ভারতের হেমকুমারী সাব-সেক্টরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর চাড্ডা, মেজর ছাতুয়াল, ক্যাপ্টেন চক্রবর্তী এখানে দায়িত্বে ছিলেন। তাদের নেতৃত্বেই আমরা সীমান্তের ডিফেন্স যুদ্ধে অংশ নেই। হেমকুমারী সাব-সেক্টরটি মূলত ৬ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ৬ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল বুড়িমারী।

আমরা এই সেক্টরের নীলফামারীর ডিমলা, ডোমার, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, বাইশপুকুর এলাকায়, শঠিবাড়ী এলাকায় ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে প্রতিরোধযুদ্ধে এবং কোনো কোনো সময়ে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে বাংলাদেশের পাক হানাদার অধিকৃত এলাকায় নির্দিষ্ট টার্গেট নিয়ে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেই। এই সেক্টরে অনেক মুক্তিযোদ্ধা কাজ করছিলেন। কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের সকলের নাম স্মরণ নেই।
তিনি আরও বলেন, বাইশপুকুর এলাকায় কাজ করার সময় আমিনুল নামে ১০/১২ বছরের এক শিশু আমাদের নানা কাজে অংশ নিত। তার কথা এখনো মনে পড়ে। বাইশপুকুর এলাকায় অবস্থানকালে প্রথম রোজার দিন ভোরে পাক সেনারা আমাদের ক্যাম্প ঘেরাও করে। তাদের মোকাবিলা করার একপর্যায়ে ওয়াপদা বাঁধের পাড়ে আমি দলছুট হয়ে একা হয়ে যাই। পাক সেনারা বাঁধের ওপর থেকে আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। জীবন রক্ষায় বাধ্য হয়ে তিস্তা নদীতে ঝাঁপ দেই।

পাক সেনারা ভেবেছিল, আমি গুলি খেয়ে ডুবে গেছি। কিন্তু আল্লাহপাক সেদিন আমাকে রক্ষা করেছিলেন। এ ছাড়াও ওই যুদ্ধকালে ঈদুল ফিতরের দিন ভারতের গিতালদহে আমরা ঈদের নামাজ যখন আদায় করছিলাম, সেখানে পাকবাহিনী মর্টার সেল নিক্ষেপ করেছিল।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অবস্থান করছিলাম বৃহত্তর রংপুর জেলার নীলফামারী মহকুমার কিশোরীগঞ্জ থানা এলাকায়। ওইদিন আমরা বিভিন্ন কোম্পানির কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধা কিশোরীগঞ্জ থানা দখল করে আরও সামনের দিকে প্রধান সড়ক ধরে এগোতে থাকি। প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে থেমে থেমে যুদ্ধ চলছিল। মেজর ছাতুয়াল সিংয়ের তত্ত্বাবধানে এই যুদ্ধ হয়। যতদূর মনে পড়ে ওই সময় ৬ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশিদ এই সাব-সেক্টরের তিনটি কোম্পানি পরিচালনা করছিলেন।

আমাদের ৬ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল এমকে বাশার, সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর নওজেশ, ক্যাপ্টেন মতিয়ার রহমান এবং ক্যাপ্টেন দেলোয়ার হোসেন। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মেজর ছাতুয়াল সিং সুখবর দেন যে, যুদ্ধ শেষ। পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছে। তিনি সব মুক্তিযোদ্ধাকে কিশোরীগঞ্জ হাই স্কুল মাঠে ক্লোজ হওয়ার নির্দেশ দেন এবং নিজ নিজ হাতিয়ার জমা করতে নির্দেশ দেন।

যুদ্ধ শেষ হলেও ১৬ ডিসেম্বরের পরেও সৈয়দপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সেখানে ভারতীয় সেনা ও আমাদের সাব-সেক্টর কমান্ডারগণ কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে যেতে দেন নাই। তারপরও আমরা শেষ অবস্থা দেখার জন্য ওই এলাকায় অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা যার যার বাড়ি ফেরা শুরু করে। আমি এবং আমার সাথী সিরাজগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা হেঁটে ও নদীপথে নৌকায় চিলমারী ও কামারজানী হয়ে সিরাজগঞ্জ আসি। সিরাজগঞ্জ কলেজে ইসমাইল ভাই এবং আমির হোসেন ভুলু ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ভুলু ভাই একটি লাল রঙের জীপ দিয়ে আমাদের বেলকুচি পৌঁছে দেন।
গাজী সাইদুর রহমান বর্তমানে বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রধান উপদেষ্টা। সোহাগপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ গাজী সাইদুর রহমান এলাকায় ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়।

×