ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

নদীতে পানি নেই

অস্তিত্ব সংকটে চলনবিল

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা

প্রকাশিত: ০০:৩১, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

অস্তিত্ব সংকটে চলনবিল

বড়াল নদীর বুকে চাষাবাদ

পানিশূন্য বড়াল এখন শুধুই হাহাকার। এককালের স্রোতস্বিনী বড়ালের বুকে এখন ধান চাষ হচ্ছে। অপরিকল্পিত বাঁধ  স্লুইস গেট নির্মাণ, দখল দূষণে বড়ালের অস্তিত্ব এখন বিলীন হতে চলেছে। বড়াল মরে যাওয়ায় দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল পানি সংকটে শুকিয়ে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। তেমনি অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকাকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত।

পদ্মার প্রধান শাখা নদী বড়াল। আর বড়াল চলনবিলের প্রধান পানি সরবরাহকারী নদী। এর দৈর্ঘ্য ২শ কিলোমিটার। বড়াল রাজশাহীর চারঘাট থেকে চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মুশাখা, নারদ, নন্দকুজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ফরিদপুর উপজেলা হয়ে যমুনা নদীর সঙ্গে মিশেছে।

ব্রিটিশ আমল থেকে নদীটি পাবনার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। উর্বরতায় সমৃদ্ধ বড়ালের দুপাড়ে তখন প্রচুর ধান, চাল, মসুর, খেসারি, সরিষা, মাস কালাই চাষ হতো। বড়াল পাড়ের ফসল নৌপথে চাঁদপুর, চট্টগাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ খুলনায় পাঠাতে চারঘাট, পুঠিয়া, বাগাতিপাড়া, দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্ট, বড়াইগ্রাম, বনপাড়া, রামনগর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, মির্জাপুর, জোনাইল, বাঘা, ডেমড়া, সিলন্দাতে নদী বন্দর গড়ে ওঠে। আশির দশকের প্রথম দিকেও বড়াল দিয়ে বড় বড় নৌকা, বার্জ, কার্গোতে পণ্যসামগ্রী আনা নেয়া হতো। এখন নদীটি বলা চলে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছে। বর্ষায় মাস দুই পানি থাকলেও সারা বছর বড়াল পানি শূন্য হয়ে পড়ে। আবার কোথাও কোথাও নদীর কোনো চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর অংশের বেশিরভাগ এলাকা শুকিয়ে গেছে। বড়ালের বুকে ধান আবাদ হচ্ছে। পানি শূন্য হওয়ায় দুপাড়ে নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িঘর, দোকানপাট। দখল প্রক্রিয়া এখনো চলছে। ভাঙ্গুড়ায় এক প্রভাবশালী ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে নদীর মধ্যে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। অপরিকল্পিত বাঁধ øুইস গেট নির্মাণের পরিণতিতে বড়ালের অবস্থা বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা নিয়ন্ত্রণে বড়াল বেসিন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখে নির্মাণ করে ক্লোজার বা তিন দরজা বিশিষ্ট øুইস গেট। পদ্মা থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া বড়াল নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধা দেওয়া হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়ি নামক স্থানে আরও একটি পাঁচ দরজাবিশিষ্ট øুইস গেট নির্মাণ করা হয়। এর ফলে দক্ষিণ দিকের অংশে পানি থাকলেও উত্তরের অংশে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এখানে বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগ নন্দকুজা এবং অপর ভাগ বড়াল। এখানেই বড়ালের মুখে নির্মাণ করা হয় এক দরজাবিশিষ্ট একটি øুইস গেট।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিণামদর্শী পরিকল্পনায় তথা øুইস গেট নির্মাণে বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার বড়ালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। নদীর ভাটিতে বড়াল নদীর ওপর তৃতীয় চতুর্থ øুইস গেট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুড়া-চাটমোহরের দহপাড়ায়। দহপাড়ার নিকটবর্তী øুইস গেটটির দুদিকে শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যাওয়ায় বড়াল দখলের উৎসব শুরু হয়। যে যেমন মনে করেছে তেমনি নদীর মধ্যে ঘরবাড়ি, মার্কেট বানিয়ে ভোগ দখল করছে। চলনবিলে পানি শূন্যতায় জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। ইতোমধ্যেই চলনবিলে ১৩০ প্রজাতির মাছের মধ্যে এখন ৭৯ প্রজাতি টিকে আছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়ালের নাব্য ফেরাতে গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে নাটোরের নারদ মুসা খান নদী রাজশাহীর চারঘাটের রেগুলেটরের ইনটেক চ্যানেল খনন নামে ১৩ কোটি লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। প্রায় ১৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার নদী খনন প্রবেশ মুখ খননে অর্থ ব্যয় হয়। প্রকল্পের আওতায় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি চারঘাট বড়াল নদীর ইনটেক চ্যানেল খনন কাজ শেষ হয়। ইনটেক চ্যানেল খনন হলেও বর্ষায় বড়ালে পানি আসেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ দায়সারা কাজ করায় নদী থেকে খনন করা বালু আবার নদীতে চলে গেছে।

 

×