ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

ব্যাংগাড়ী মাঠের যুদ্ধে তিনশ’র বেশি পাক সেনা নিহত হয়

মো. সাইদুল আনাম, দৌলতপুর, কুষ্টিয়া

প্রকাশিত: ০০:০৩, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩; আপডেট: ১৯:০৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ব্যাংগাড়ী মাঠের  যুদ্ধে তিনশ’র  বেশি পাক সেনা  নিহত হয়

.

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন দৌলতপুরের দৌলতপুর ইউনিয়নের দাড়েরপাড়া গ্রামের দামাল ছেলে জান মোহাম্মদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের সময় ছিলেন টগবগে তরুণ। বৃদ্ধ বয়সে এসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা জান মোহাম্মদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ১৫ বছরের যুবক ছিলাম। যুদ্ধ চলাকালে এলাকার মতিউর রহমান, আব্দুল বারী ও আমিসহ ৩২ জন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য এপ্রিলে ভারতে যাই। সেখানে চাকুলিয়ায় ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং কমান্ডার হাবিলদার মনোসিংয়ের অধীনে ৩৫ দিন প্রশিক্ষণ নেই। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এলএমজি, স্টেনগান, রাইফেল, গ্রেনেড, এসএলআরসহ বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেই। ৩৫ দিন প্রশিক্ষণের পর প্রায় এক হাজার জনের একটি গ্রুপের মধ্যে ধর্মদহ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামসহ আমাকে ৮নং সেক্টরের অধীনে পাঠানো হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জান মোহাম্মদ বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয় দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদহ ব্যাংগাড়ীর মাঠে। এলাকাবাসীর কাছে  এখন এটা ‘ব্যাংগাড়ীর মাঠের যুদ্ধক্ষেত্র’ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্য নিহত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছর পার হলেও আজও সংরক্ষণ করা হয়নি যুদ্ধক্ষেত্রের এ স্থানটি।

তিনি আরও বলেন, দৌলতপুরের আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ধর্মদহ ব্যাংগাড়ীর মাঠ থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার করিমপুর থানার শিকারপুর মুক্তিযুদ্ধ সাব-সেক্টর সদরের দূরত্ব ছিল মাত্র দেড় মাইল। আর এ সাব-সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মেজর নুরুন্নবী। এ সাব-সেক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নভেম্বর মাসের দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী ওই এলাকায় এক প্রতিরক্ষা বেষ্টনী গড়ে তোলে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই এ খবর পৌঁছে যায় পার্শ্ববর্তী পাক হানাদার ক্যাম্পে। আর এ খবর পাওয়ার পর ১১ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর ওপর দুদিক থেকে অতর্কিতে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে পাক হানাদার বাহিনী। তবে রাতদিন ধরে চলা এ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও  মিত্র বাহিনীই জয়ী হয়। যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্য নিহত হয়। তবে জীবিত থাকা পাক বাহিনীর সদস্যরা পিছু হটার সময় তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধাÑসোহরাব উদ্দিন, শহিদুল ইসলাম ও মসলেম উদ্দিন এবং মিত্র বাহিনীর তিন সদস্যকে জীবিত ধরে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিত্র বাহিনীর তিন সদস্যকে ফেরত দিলেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধসহ ছোট-বড় ১৬টি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এসব যুদ্ধে ৩৫ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকশ’ নারী-পুরুষ শহীদ হন। ৮ ডিসেম্বর সকালে আল্লারদর্গায় পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাক সেনারা। এর পর ৮ ডিসেম্বর দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন ৮নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নুরুন্নবী। শত্রুমুক্ত করে থানা চত্বরে বিজয় পতাকা ওড়ানোর মধ্য দিয়ে মুক্তিকামী বীর সন্তানেরা দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করেন।

×