ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

বোমা মেরে ৭৫ রাজাকারকে একসঙ্গে হত্যা করি

শেখ আব্দুল আওয়াল, গফরগাঁও

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বোমা মেরে ৭৫ রাজাকারকে একসঙ্গে হত্যা করি

সিরাজুল হক

টগবগে যুবক, সুঠাম দেহের অধিকারী। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান। অনেক স্বপ্ন অনেক আশা। নবম শ্রেণি পাস করেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি নেয়। সেদিন দেশমাতৃকার টানে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসে দেশে। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে স্বাধীনতার স্বপ্ন মনের মধ্যে উঁকি দেয়। ২৫ মার্চ গভীর রাত থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ করে।

এরই মধ্যে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় দেশ স্বাধীন করার সংগ্রামে। ‘মা শুধু বললেন, পাকিদের হাতে আত্মসমর্পণ করার চেয়ে যুদ্ধ করে মরা অনেক ভালো’। যাও বাবা, তোমার সঙ্গে শেখ মুজিব ও আমার দোয়া আছে। এই যুবকটি আর কেউ নয়, ময়মনসিংহের গফরগাঁও পৌরশহরের ৭নং ওয়ার্ডের শিলাসী গ্রামের সিরাজুল হক ওরফে বোমা সিরাজ।
গফরগাঁও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে বলেন, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের কোয়েটার প্রশিক্ষণ শেষ করে করাচির মালিরক্যান ক্যান্টনমেন্ট চাকরিতে যোগ দেই। ১৯৭১ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি তিন মাসের ছুটিতে বাড়িতে আসি। ছুটিতে থাকাবস্থায় মাথায় চিন্তা এলো আর চাকরিতে যাব না। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা আসে।

মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এলাকার ছাত্র-যুবকদের নিয়ে ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু করি। এরপর ১৭ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে পাকিস্তানি জেট বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয় গফরগাঁও থেকে। দলবল নিয়ে গফরগাঁও থানা আক্রমণ করে অস্ত্র লুট করে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। 
এপ্রিলের শেষের দিকে ত্রিশাল, ভালুকা, গফরগাঁওয়ের ছাত্র-যুবক ও জনতাকে নিয়ে ভালুকার মেজর আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বে ১১নং সেক্টরের অধীনে মল্লিকবাড়ির হেড কোয়ার্টারে অবস্থান করি।

জুলাই/আগস্ট মাসের দিকে পাক বাহিনী ভালুকা আক্রমণ করতে যাওয়ার পথে ভাওয়ালিয়া বাজুবাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে শহীন হন আব্দুল মান্নান, আহত হন আফাজ উদ্দিন ভুঞা। ওই ৩৬ ঘণ্টার যুদ্ধে ৫০ জনের মতো পাক সেনা নিহত হয়, আহত হয় দেড় শতাধিক। এরপর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মেজর আফসারের নির্দেশে আমার নেতৃত্বে ত্রিশালের কাশিগঞ্জে ও গফরগাঁওয়ের রসুলপুর ইউনিয়নের আমলিতলা এলাকায় বোমা মেরে দুটি ক্যাম্প দখল করি।

ওই যুদ্ধে প্রায় ২৫০ পাকি সেনা, আনসার, মোজাহিদ, রাজাকার, আলশামস, আলবদর আত্মসমর্পণ করলেও শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন। আমার দল আগরতলা হাপানিয়া ক্যাম্প থেকে নবীনগর কসবা আলগীরচর হয়ে যুদ্ধে যাই। যুদ্ধে যাওয়ার আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাহাব উদ্দিন ম-ল আমাদের পরিচয়পত্র দেন ভারতের আগরতলায় প্রশিক্ষণের জন্য।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, গফরগাঁও, ভালুকা, ত্রিশাল, হোসেনপুর ও নান্দাইল এই পাঁচটি থানায় পাকবাহিনীর হেড কোয়ার্টার ছিল গফরগাঁওয়ের সদরে কলেজ রোডের ডাকবাংলো। এখানে বসেই চালানো হতো পাঁচ থানার সাধারণ মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন। একদিন মুক্তিযোদ্ধা বেলাল ভাই ও মেজর আফসার উদ্দিন নির্দেশ দিলেন, ‘বোমা সিরাজ, অপারেশন ডাকবাংলো’। তার নির্দেশে নভেম্বরের মাঝামাঝি রাত ১০টার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে ডাকবাংলোতে পাকিদের হেড কোয়ার্টারে আক্রমণ করি।

দুঃখের বিষয় ওইদিন বোমা বা গ্রেনেড ড্যামেজ থাকায় কোনো কাজই হয়নি। এরই মধ্যে মনে মনে পণ করলাম, যুদ্ধ করতে করতে মরে যাব। তবুও মায়ের কথায় দেশ স্বাধীন করব। কাশিগঞ্জের যুদ্ধে বোমা মেরে ৭৫ রাজাকারকে হত্যা করা হয় একসঙ্গে, ওটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ। 
বোমা ছুড়তে ছুড়তে এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। সহকর্মীরা ভেবেছিল মারাই গেছি, হয়তো দেশের স্বাধীনতা দেখার জন্যই আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমরা ১১নং সেক্টর কমান্ডার পরিচালক হামিদুল্লাহ খানের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি। ৯ ডিসেম্বর ভোরের সোনালি সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তির উল্লাসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। হানাদারমুক্ত হয় গফরগাঁও।

×