
গাছে গাছে ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য
মাঘের তীব্র শীত পেরিয়ে কয়েকদিন পরেই প্রকৃতিতে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন ঘটবে। আর সেই আগমনী বার্তা ছড়াচ্ছে গ্রামের পথে প্রান্তরে। যেন উদাসী মনে আকাশ পানে চেয়ে আছে সদ্য ফোটা শিমুলের দল। রক্তিম মনোলোভা শিমুল ফুলগুলো। বাংলা সাহিত্যের পাতায়ও স্থান পেয়েছে শিমুলের রক্তরাঙ্গা ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য।
প্রকৃতিতে ফুটে থাকা শিমুল ফুল নিয়ে কালজয়ী অনেক গান রচিত হয়েছে যেমন ‘শিমুল যদি হইতাম আমি শিমুলেরই ডালে শোভা পাইতো রূপ আমার ফাগুনেরও কালে’।
শষ্যভান্ডারখ্যাত চলনবিল অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে রাস্তার পাশে শিমুল ফুলের সৌন্দর্য প্রকৃতি প্রেমিদের নজর কাড়ছে। সেই সঙ্গে পাখপাখালি আর মৌমাছিদের আনাগোনা চোখে পড়ার মত দৃশ্য পথচারীদের মুগ্ধ করছে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় অপরূপ সাজে সজ্জিত শিমুল গাছ ও ফুল প্রায় বিলুপ্তির পথে। বসন্ত আসার আগেই গাছে গাছে শিমুল ফুল ফুটতে শুরু করেছে।
বসন্তের আগমনে শীতের রিক্ততা ভুলিয়ে ফাল্গুনের আগুনে মানুষের মন আর প্রকৃতিতে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। মাঘের শেষ হতে এখনও কয়েকদিন বাকি, আর এরই মধ্যে প্রকৃতিতে বইতে শুরু করেছে বসন্তের হাওয়া। বসন্তের রঙ্গ ও রূপে নিজেকে সাজাতে প্রকৃতি এখন মেতে উঠেছে। প্রকৃতি ধারণ করছে রূপ লাবন্যে ভরা মনোমুগ্ধ পরিবেশ। ঋতুরাজ বসন্ত তার আগমনী বার্তা নিয়ে প্রকৃতির দরজায় কড়া নাড়ছে। বছর ঘুরে প্রকৃতি তার নানা পরিবর্তন পেরিয়ে আবার সেজেছে নতুন রূপে।
চাটমোহর উপজেলার বিভিন্ন সড়কে দেখা মেলে, নতুন কুঁড়ি ও ফুলে শিমুল গাছ রঙিন হয়ে উঠছে। শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে প্রকৃতি ফিরে পেতে চলছে ফুল, ফল ও সবুজের এক অপরূপ সমারোহ। যা আগমনী বার্তা ছড়াচ্ছে বসন্তের। নানা প্রজাতির পাখিরা তার মিষ্টি কুহুতানে মাতাল করতে আসছে ঋতুরাজ বসন্ত সবুজ-শ্যামল বাংলায়।
উদ্ভিদ বিদ মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুর চারিত্রিক পরিবর্তন হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও প্রকৃতিতে। বসন্ত ঋতু আসার আগে শিমুল ফুল ফোঁটার পেছনেও আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। দৃষ্টিনন্দন ফুলের মধ্যে শিমুল ফুল সৌন্দর্য প্রেমীদের কাছে অনেকটাই শোভা পায়।’
প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী ঋতু বদলায় তার রূপ, রং আর সৌন্দর্য নিয়ে। বসন্তের বার্তা নিয়ে শিমুল গাছের কলি খাওয়ায় মেতে উঠেছে পাখির দল। সেই সঙ্গে আম, লিচু, জাম ও বেল গাছ মুকুলে ভরে উঠেছে।
শুভ্র ফুলে ভরে গেছে ‘মিরাকেল ট্রি খ্যাত’ সজনে গাছ
বসন্তের রং ও রূপে নিজেকে সাজাতে শিমুল গাছ নতুন কুঁড়ি ও ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে ঠিক তেমনই মাঘ ও ফাল্গুন মাসে সজনে গাছ ভরে ওঠে শ্বেত শুভ্র ফুলে। এ সময় সজনে ফুলের রূপ আমাদের মোহিত করে। সজনের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমানে পুষ্টি উপাদান থাকায় এগুলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি জীবন ধারনের পুষ্টির যোগান ও দেয়। এর শিকড়ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। নিম পাতার চেয়েও বেশি ওষুধি গুনাগুন থাকে সজনে পাতায়। এটি সহজলভ্যও বটে। সজনে চাষ সম্প্রসারণে, রাস্তার পাশে সজনে গাছ লাগাতে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। প্রাণি খাদ্য হিসেবেও সজনে পাতা ব্যবহৃত হয়।
গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত বৃক্ষ সজনে গাছ। বসত বাড়ির আঙিনা, রাস্তার আশ পাশে অবহেলা, অনাদরে সজনে গাছ বেড়ে ওঠে। গাছের মালিককে এর পরিচর্যা করতে হয়না বললেই চলে। বছরে একবার সবজির জোগান দিলেও সারা বছর শাক হিসেবে এর পাতা পাওয়া যায়। সবজি হিসেবে সজনের কচি ডাটা যেমন উপাদেয় এবং পুষ্টিকর তেমনি এর পাতাও ওষুধি গুনে ভরপুর। তাই গবেষকরা সজনে পাতাকে নিউট্রিশন্স সুপার ফুড এবং সজনে গাছকে মিরাকেল ট্রি বলে অভিহিত করেন।
চাটমোহর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, সজনে গাছ খরাসহিষ্ণু গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ।
বাগানে উঁকি দিচ্ছে লিচু ফুলের মুকুল
চাটমোহর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অনেক বাসাবাড়ির আঙ্গিনায় লাগানো রয়েছে লিচু গাছ। মাঘ মাসেই লিচু গাছের লাল-সবুজ পাতার মাঝে সবুজ ডগায় মুকুল এসেছে। এতে প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সাজে। লিচু চাষিরা এখন লিচু বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত। লিচু গ্রাম বলে খ্যাত উপজেলার গুনাইগাছা, রামচন্দ্রপুর, মন্ডলপাড়া, বড় শালিখা, জালেশ্বর সহ আশপাশের গ্রামের বাগান গুলো লিচুর মুকুলে ছেয়ে গেছে। এছাড়াও উপজেলার হরিপুর, ধরইল, বোঁথর, মথুরাপুর, খয়েরবাড়িয়াসহ অন্যান্য এলাকার গাছগুলোতে লিচুর মুকুল উঁকি দিচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবার পরবর্তী আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে গত মৌসুমের মতোই লিচুতে লাভবান হবেন কৃষকেরা।
চাটমোহর মূলগ্রাম এলাকার চাষি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ইতোমধ্যেই প্রতিটি গাছেই লিচুর মুকুল এসেছে। এ উপজেলায় চাষ হয় চায়না থ্রি, বোম্বাই, কাঁঠালি ও স্থানীয় জাতের লিচু। গত মৌসুমে লিচু চাষিরা লিচু বিক্রি করে যথেষ্ট লাভবান হয়েছিল। এখনও আবহাওয়া অনুকুলে আছে, এবার আরও বেশি লাভবানের আশা করা যাচ্ছে।
উপজেলার সব এলাকায় কমবেশি লিচুর চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় রামচন্দ্রপুর, জালেশ্বর, গুনাইগাছা, হরিপুর, ধরইল, ধুলাউড়ি, বড় শালিখা, বড় গুয়াখড়া এবং মূলগ্রাম এলাকায়।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, উপজেলায় প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে লিচুবাগান রয়েছে। এছাড়াও বসতবাড়ির উঠানসহ বাড়ির আশপাশেও অনেক লিচু গাছ আছে।
লিচু চাষি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘৩০ গাছ নিয়ে একটি বাগান আছে তার। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা এখন বাগান কেনার জন্য আসছেন। মুকুল দেখেই তারা বাগান কিনছেন।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ এ মাসুমবিল্লাহ বলেন, ‘মুকুল ছাড়ার আগে গাছের গোড়ায় পানি দেওয়া হলে কিংবা বিষ প্রয়োগ করলে গাছ কচিপাতা ছাড়ে। মুকুল থেকে গুটি হতে শুরু করলে হপার পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে একবার বিষ প্রয়োগ করতে হয়। মুকুল দেরিতে এলেও ফলন সন্তোষজনক হবে বলে আশা করছেন তিনি। চাটমোহরে প্রতিবছরই লিচুর আবাদ বাড়ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
পাগল করা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে আম মুকুল
বসন্তের রং ও রূপে নিজেকে সাজাতে শিমুল গাছ নতুন কুঁড়ি ও ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে, ঠিক তেমনই মাঘ ও ফাল্গুন মাসে সজনে গাছ ভরে ওঠে শ্বেত শুভ্র ফুলে তার সাথে পাল্লাদিয়ে মধুমাসের আগমনী বার্তা শোনাচ্ছে আমের মুকুল।
বাতাসে মিশে সৃষ্টি করছে মৌ মৌ গন্ধ। যে গন্ধ মানুষের মনকে বিমোহিত করে। পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের ‘মামার বাড়ি’ কবিতার পংক্তিগুলো এখন বাস্তব রূপ পাচ্ছে। কবি তার পংক্তিগুলোতে বলেছেন, ‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা, ফুল তুলিতে যাই, ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ে যাই। ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ, পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।’ সুখের ঘ্রাণ বইছে গাছে গাছে ফুটা আমের মুকুল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে এই মুকুলের পাগল করা ঘ্রাণ।
আম বাগানে শোভা পাচ্ছে কেবলই মুকুল। এ যেনো হলুদ আর সবুজের মহামিলন। মুকুলে ছেয়ে আছে গাছের প্রতিটি ডালপালা। চারদিকে ছড়াচ্ছে সেই মুকুলের সুবাসিত পাগল করা ঘ্রাণ। তবে আমের ফলন নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন বাগান মালিকরা।
এ দিকে, মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মুকুলে ভরে গেছে বাগানসহ ব্যক্তি উদ্যোগে লাগানো আম গাছগুলোতে। দেখা যাচ্ছে বড় আকারের চেয়ে ছোট ও মাঝারি আকারের গাছে বেশি মুকুল ফুটেছে। সেই মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে বাগান মালিকদের চোখে ভাসছে স্বপ্ন। দেশি জাতের আমের পাশাপাশি ফজলি, আমরূপালি, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ক্ষিরসা অন্যতম। ইতিমধ্যে এসব গাছে মুকুল আসা শুরু হয়েছে। গাছের পুরো মুকুল ফুটতে আরও এক দুই সপ্তাহ লাগবে বলে জানান বাগান মালিকরা।
চাটমোহর হরিপুর এলাকার গোপালপুরের গ্রামের আবু মুসা বলেন, ‘এবার প্রায় তিন বিঘা জমিতে আমচাষ করেছি। আশা করছি ভালো ফলন পাবো।
উপজেলার কয়েকজন বাগান মালিক জানান, প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে তাদের বাগানে লাগানো আম গাছে মুকুল আসা শুরু হয়েছে। বেশিরভাগ গাছ মুকুলে ছেয়ে গেছে। অনেক গাছে গাছে মুকুল বের হচ্ছে।
চাটমোহর উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুয়ারী, উপজেলায় ৬১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ এবং তা থেকে প্রায় ১০ হাজার মেট্টিকটন আম উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এমএইচ