ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

রাতে তুমুল গোলাগুলি, সকালে দেখি রাস্তায় ১৪ পাকসেনার লাশ

আবুল বাশার, শরীয়তপুর

প্রকাশিত: ০০:০৯, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩

রাতে তুমুল গোলাগুলি, সকালে দেখি রাস্তায় ১৪ পাকসেনার লাশ

আলী আহম্মদ সরদার

মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি। যুদ্ধদিনের সেসব কথা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে। অনেক স্মৃতির মধ্যে কুমিল্লার চান্দিনার যুদ্ধটাই মনে দাগ কাটে সবচেয়ে বেশি। রাতে তুমুল গোলাগুলির পর সকালে দেখি ১৪ পাকসেনার লাশ রাস্তায় পড়ে আছে। দীর্ঘ প্রায় এক মাইলজুড়ে রাস্তার দু’পাশে বাংকার তৈরি করে অ্যাম্বুশ করি। রাতে পাকসেনারা আমাদের সেই অ্যাম্বুশের মধ্যে পড়ে। তখনই আমাদের কমান্ডারের কাছ থেকে রেড সিগন্যাল পাই।

অ্যাম্বুশের মধ্যে পেয়ে আমরাই প্রথমে অতর্কিত আক্রমণ করি। পাকসেনারা তখন কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। তার পরও তারা ডিফেন্স দিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা ধোপে টেকেনি। মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তার দু’পাশ থেকে মুহুর্মুহু গুলি চালিয়েছে। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। একপর্যায়ে তারা পিছু হটে। কিছু পাকসেনা দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাকিরা নিহত হয়। সকালে দেখি ১৪ পাকসেনার রক্তাক্ত মৃত দেহগুলো রাস্তায় পড়ে আছে।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর এমন স্মৃতিচারণ করেছেন শরীয়তপুর সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নের মাকসাহার গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী আহম্মদ সরদার।
স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সারারাত নদীর কিনারায় লডা ক্ষেতের মধ্যে পানিতে ডুবে মাথায় কচুরিপানা দিয়ে লুকিয়ে থেকে জীবনটা বাঁচিয়ে এনেছি। এর চেয়ে আর জীবনের বড় ঝুঁকি কি হতে পারে? প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাওয়ার সময় জীবনের শুরুতেই এ রকম একটি ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমার জীবনে এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন বিপদের সময়। ভাবতে পারিনি বেঁচে থাকব। মহান আল্লাহ রহমত করেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী আহম্মদ সরদার বলেন, প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতে যাওয়ার পথে ট্রলারে গোমতী নদী পার হতে গিয়ে ভয়ানক সমস্যায় পড়ি। স্পিড বোট যোগে পাকসেনারা নদীতে টহল দিচ্ছে। দূর থেকে দেখি রাস্তায়ও পাকসেনাদের টহল। কোথাও লুকাবার জায়গা নেই। জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেই। আমার সঙ্গে থাকা অন্য মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ট্রলারের পাটাতনের নিচে লুকিয়েছিল, কেউ আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। আমি ডুব দিয়ে দিয়ে পাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে লডা ক্ষেতে আশ্রয় নিই।

মাথায় কচুরিপানা আর লতাপাতা দিয়ে ঢেকে কোনো রকমে নাকটা পানি থেকে একটু উঁচু করে জীবন বাঁচাই। সারারাত কেটে গেল। হাঁটুর নিচে একটি কালো জোঁক প্যাঁচানো দেখে নিজেই তা টেনে ছিটকে ফেলি। সকালে পাকসেনাদের না দেখে পাশের একটি বাড়িতে উঠি। কিন্তু বাড়িতে এক মহিলা আমাকে ভেজা কাপড়ে দেখে কিছুতেই সেখানে আশ্রয় দেবে না। আমি তাকে মা ডেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে দু’পা জড়িয়ে ধরলাম। তাকে শুধু একটা দিনের জন্য একটু আশ্রয় দিতে বলি।

কিন্তু তিনি রাজি হচ্ছিলেন না রাজাকারদের ভয়ে। বলেন, রাজাকাররা জানতে পারলে আমার ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় রাস্তায় পাকসেনারা টহল দিচ্ছে। কিন্তু আমার একটু বেঁচে থাকার কাকুতি-মিনতি শুনে তার দয়া হল। একটি শুকনো লুঙ্গি দিল আর একটি পরিত্যক্ত ঘরে হোগলা পেঁচিয়ে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকার অনুমতি দিল। ক্ষুধায় অস্থির। মনে করিনি বেঁচে থাকব। তার পরও আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন।
মাকসাহার গ্রামের মৃত আ. হাই সরদারের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী আহম্মদ সরদার মুক্তিযুদ্ধের পালং তুলাসার গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনছিলেন রেডিওতে। তার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে এই তরুণের। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে বাবা-মাকে না জানিয়ে তৎকালীন পালং থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান চৌধুরীর হাত ধরে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায় আলী আহম্মদ।

তাদের সঙ্গে শরীয়তপুর সদরের আঙ্গারিয়ার ইয়াকুব আলী হাওলাদার (মৃত), রুদ্রকরের জহির উদ্দিন তালুকদারসহ (মৃত) ১৫/১৬ জন ছিল। পালং থেকে প্রথমে নৌকাযোগে সুরেশ^র পৌঁছান তারা। তার পর ট্রলারে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে কুমিল্লার মোহনপুর হয়ে বুড়িচং থানা এলাকায় পৌঁছান তারা। এর পর গোমতী নদী পার হয়ে কুমিল্লা, তারপর তৎকালীন পাংতি, কবজা থানার কোনাবন দিয়ে ভারতে যান। প্রথমে ত্রিপুরার তিতাস ক্যাম্পে রিক্রুট হয়ে আম্পিনগর ট্রেনিং সেন্টারে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে থ্রিনটথ্রি, বন্দুক, এসএমজি, মেশিনগানসহ অন্যান্য ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণ শেষে মেলাঘর দিয়ে দেশে এসে ৮নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন তিনি। দাউদকান্দি, চান্দিনাসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী আহম্মদ জানান, তখন শুনতে পাই বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভাবছি বাবা-মাকে আর কখনো দেখতে পাব না। তবে বাবা-মা বেঁচে ছিল কিন্তু তাদের সুপারি গাছের সঙ্গে বেঁধে ভয়াবহ নির্যাতন করেছে রাজাকাররা। সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করে মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী আহম্মদ সরদার বার বার চোখের পানি মুছলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী আহম্মদ সরদার বর্তমানে রুদ্রকর ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশিং ও রুদ্রকর ইউনিয়ন দুর্নীতি দমন কমিশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

×