ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পকলায় ‘বাংলার আপন সৌধ’ প্রদর্শনীর উদ্বোধন

প্রকাশিত: ১০:০১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  শিল্পকলায় ‘বাংলার আপন  সৌধ’ প্রদর্শনীর উদ্বোধন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গ্যালারিজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির শহীদ মিনারের ছবি। কোনটি করা হয়েছে মাটি দিয়ে, কোনটি কাগজ, কোনটি বাঁশ অথবা কলাগাছ দিয়ে। সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে ভাষা শহীদদের। এ শহীদ মিনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নয়, কিন্তু সেখানের পরিবেশ দেখলে মনে হয় মাতৃভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কোন কমতি নেই এখানে। এ শহীদ মিনারগুলো তৈরি করেছে গ্রামের শিশুরা। আলোকচিত্রী মোহাম্মদ খুরশিদ আলম আলোক বিগত বিশ বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছোটদের তৈরি এ শহীদ মিনারগুলোর আলোকচিত্র গ্রহণ করেছেন। শিশুদের বানানো শহীদ মিনারের আলোকচিত্র নিয়ে রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ৩নং গ্যালারিতে শুরু হয়ে ‘বাংলার আপন সৌধ’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী। একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার বিকেলে ১০ দিনব্যাপী এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন শিল্পী নাসিম আহমেদ নাদভী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। প্রদর্শনী উদ্বোধনের সময় শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, সকলের বুকের মধ্যে শহীদ মিনার আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাজি ফুটল হৈ চৈ হলো এমন বিষয় নয়। হৈ চৈ করে তো শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো যায় না। শহীদরা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিল নিজের ভাষা। কিন্তু আমাদের এখন কত কি হচ্ছে বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের ভেতরের সেই ইচ্ছাটা বোধ হয় কমে গেছে। এ কথা বলতে হয় যে, আমরা অনেকেই নিজেকে অনেক ভীষণ ভীষণ গর্বিত মানুষ ভাবি। এই ভাষায় কথা বলি এটা যে কত বড় সৌভাগ্য বলে শেষ করা যাবে না। পৃথিবীকে জানা, প্রকৃতিকে জানা সবকিছুকে জানার যে ভাষা সেই ভাষা বাংলা ভাষা। এই ভাষাতেই আমাদের সব কবিরা মনের কথা, প্রাণের কথা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন ফকির সবাই এ ভাষাতে আমাদের হৃদয়ের কথা লিখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ কতভাবে- কতবার- বলেছেন বাংলাভাষা ছাড়া আমাদের উচ্চশিক্ষা সম্ভব না। তিনি বলেছেন, আমরা বাঙালী চাই, ভাবুক চাই, আমি শ্রষ্টা চাই। মাতৃভাষা শুধুমাত্র আমার মায়ের ভাষা না, এটা চিরন্তন কোটি কোটি মায়ের মনের ভাষা। বাংলাভাষা যে কি অসাধারণ ভাষা দেশের বাইরে গেলে আরও বেশি অনুভূত হয়। আজকের যে প্রদর্শনী এখানে আয়োজন করা হয়েছে শহীদ মিনার নিয়ে। এটা অসাধারণ একটি ভাবনা থেকে করা হয়েছে আমি মনে করি। শহীদ মিনার এখন বলে বলে করাতে হচ্ছে। অনেক স্কুল এখনও বলে না এগুলো করব না। আগে সবাই বলতাম অনেক চিৎকার করেছি যে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এখন বলতে হবে ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’। প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, মিলনায়তনে প্রবেশের আগে এই প্রদর্শনীর আলোকচিত্রগুলো দেখে এসেছি। এটা দেখতে দেখতে আমি আমার অনেক অতীতে চলে গিয়েছিলাম। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন তখন আমি স্কুলের ছাত্র। আমি তখন সে আন্দোলনের চিত্র দেখেছি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। এই আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। এবং তখন কিছু ছবি তোলার চেষ্টাও করেছিলাম। সে ছবিগুলো পরে অনেক গুরুত্ব পেয়েছে। তখন প্রথম শহীদ মিনারটি তৈরি হয় মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলের ওখানে। একুশ তারিখ গুলি হলো, ২৬ তারিখের মধ্যে এটি তৈরি হয়ে উদ্বোধনও হয়েছে। এটি বাঙালীর একটি পবিত্র স্থানে পরিণত হয়েছিল। ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানী বাহিনী এটি বুলড্রোজার দিয়ে একেবারে গুঁড়িয়ে দেয়। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজের মেয়েরা একটি শহীদ মিনার নির্মাণের চেষ্টা করে। সেটাও পরে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর থেকে কালো কাপড় ঘেরা ওইটি শহীদ মিনার ছিল। যেখানে ভাষা শহীদের রক্ত পড়েছিল। শহীদ মিনার এমন একটি প্রতীক আমাদের কাছে দেয়া হলো সেটা সমবেত চিত্তাকর্ষক। ’৫৩ সাল থেকে সারা বাংলাদেশে শহীদ মিনার নির্মিত হলো। সে শহীদ মিনার সব সময় যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে তৈরি হতো তা নয়, স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রী বা গ্রামবাসীরা তাদের মতো করে শহীদ মিনার তৈরি করতেন। সেখানে তারা ফুল দিতেন, সেখানে তারা প্রভাত ফেরি করেছেন এবং শহীদদের উদ্দেশে তারা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এটা আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে গিয়েছিল। যারা সেই অস্থায়ী শহীদ মিনারগুলো তৈরি করতেন একুশে ফেব্রুয়ারির আগে সেখানে তাদের যে আন্তরিকতা তার কোন অভাব ছিল না। এবং মাতৃভাষার প্রতি, এরজন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের প্রতি আন্তরিক দুঃখ, বেদনা সবকিছুই ছিল। এরমধ্যে কোন রকম কৃত্তিমত্তা ছিল না। আগে বিভিন্ন জায়গায় প্রভাত ফেরির গান শোনা যেত। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না ভুলব না’ এই ধরনের গান গেয়ে যেখানে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাত। এটা একটা সংস্কৃতি ও রীতি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আজকের এই আলোকচিত্র যেগুলো বিভিন্ন গ্রামের মাটি অথবা অন্যান্য গ্রামীণ উপদান দিয়ে এ শহীদ মিনারগুলো বানিয়েছে এটা দেখলে বোঝা যায় যে শহীদ মিনারের ধারণাটা কত গভীরে প্রবেশ করেছে। জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যদিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এরপর ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিল্পকলা একাডেমির এ কে এম রফিকুল ইসলাম। প্রদর্শনী চলবে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
×