ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

পারস্পরিক অবিশ্বাস ও কাদা ছোড়াছুড়ি বাড়ছে

খালেদার অনুপস্থিতিতে বিএনপিতে চেন অব কমান্ড নেই

প্রকাশিত: ১০:২৫, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

  খালেদার অনুপস্থিতিতে বিএনপিতে চেন অব কমান্ড নেই

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও কাদা ছোড়াছুড়ি বেড়েই চলছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলে চেইন অব কমান্ড না থাকায় এ অবস্থা হয়েছে। এদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ক্ষমতাবলে লন্ডন থেকে একক সিদ্ধান্তে দল পরিচালিত করতে চাইলেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন সিনিয়র নেতারা। তারা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও বিভিন্নভাবে তারেক রহমানের কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন। এ নিয়ে বিএনপিতে এখন চরম অস্থিরতা চলছে। সূত্রমতে, গতবছর ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই দলে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। এর ফলে কেউ কাউকে মানছেন না। পারস্পরিক অবিশ্বাস আর কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে সর্বস্তরে দলীয় কর্মকান্ডে অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। দলের কর্মসূচী পালনের ক্ষেত্রেও মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের মধ্যে এক নেতা একটি প্রস্তাব করলে অন্য নেতা তার উল্টো প্রস্তাব দিয়ে বসেন। তারেক রহমানের চাপে কখনও কখনও সবার সিদ্ধান্তে কোন কর্মসূচী নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তাতে বাগড়া দেয় কোন কোন নেতা। এর ফলে দলীয় কোন কর্মসূচীই সফল করতে পারছে না বিএনপি। এদিকে বিএনপি নেতারা কথায় কথায় আন্দোলনের কথা বললেও বাস্তবেই অধিকাংশ নেতাই তা চান না। রাজপথে নেমে হয়রানির শিকার হতে চায়নি বলেই তারা কৌশলে আন্দোলনকে এড়িয়ে চলছেন। সম্প্রতি তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাপে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে আন্দোলনের প্রস্তুতি জোরদার করা হয়েছে বলে জানান। কিন্তু মির্জা ফখরুলের এ আন্দোলনের আশ্বাস যে সত্যিকারের আশ্বাস নয়, তা জানানোর জন্য আরেক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ঘরে বসে সভা-সেমিনারে আন্দোলনের কথা না বলে রাজপথে নেমে আসুন। আন্দোলনের কথা বলে ঘরে বসে থাকলে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। কেউ না নামলেও আমি রাজপথে নামতে রাজি আছি। খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্রয়োজনে রাজপথে জীবন দেব। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলের আরও ক’জন সিনিয়র নেতা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার খোরাক হয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান একক সিদ্ধান্তে দলের যাবতীয় কর্মকা- পরিচালনা করতে চাইলেও দেশে অবস্থান করা সিনিয়র নেতারা তার কাজে পরোক্ষভাবে বাধা দিচ্ছেন। তবে দলে অবস্থান খর্ব হওয়ার ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। তারেক রহমান লন্ডনে বসে নেতাদের আন্দোলনের জন্য রাজপথে নামার নির্দেশ দিলেও তার এ নির্দেশ মানছেন না কেউ। আর এ কারণেই দলের নেতারা মুখে আন্দোলনের কথা বললেও বাস্তবে আন্দোলন শুরু করছেন না তারা। বিএনপির মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা চলছে তা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অতি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্য থেকেই বুঝা যায়। বিএনপির সিনিয়র নেতা এম মোরশেদ খান ও লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিনিয়র নেতারা পদত্যাগ করেছেন এটা এখনও জানি না। এ ছাড়া দল থেকে আরও কেউ দল ছেড়ে যাচ্ছেন কি না এমন তথ্যও আমার জানা নেই। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পারস্পরিক অবিশ্বাস, চেইন অব কমান্ড না থাকা এবং লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের সঙ্গে দেশে অবস্থান করা নেতাদের মধ্যে দলীয় কর্মসূচী নিয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি না হওয়ায় দলটিতে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অস্থিরতা কাটিয়ে দলকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে বার বার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বর্তমানে দলে যে বিশৃঙ্খলা চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বাইরে থাকাকালে এমনটি ছিল না। এখন কিছু নেতার মধ্যে এমন ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে যেন তারাই দলের সব। এ ছাড়া বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে দলীয় কর্মকান্ডে বাধা সৃষ্টি করছে। আর কেন্দ্রীয় নেতাদের এ অবস্থা দেখে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে। যে কারণে এখন দলীয় কর্মকান্ড ও গতি হারাচ্ছে। বিএনপির রাজনীতিতে পারস্পরিক অবিশ্বাসের একটি অন্যতম কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপির রাজনীতিতে তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে একটি বড় অংশের আপত্তি ছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সময় মূল ধারার বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করে দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা মিলে যে সংস্কারপন্থী বিএনপি গঠন করেছিল তার মূল কারণ ছিল দলে তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ সহ্য করতে না পারা। পরে খালেদা জিয়া সুকৌশলে সংস্কারপন্থী কিছু নেতাকে দল থেকে সরিয়ে দিয়ে এবং বাকি নেতাদের কাছে টেনে সংস্কারপন্থী বিএনপির বিলুপ্তি ঘটিয়ে দলে ঐক্য ফিরিয়ে এনেছিলেন। গতবছর ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে লন্ডনে বসে বিএনপির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়ায় এবং তার কথা ছাড়া দলের কোন কাজ না হওয়ায় আবারও ক্ষুব্ধ হতে থাকেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এ ছাড়া তারেক রহমানের কিছু অনুসারী নেতা তার দোহাই দিয়ে দলের সবকিছুতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করায় অন্য নেতারা ক্ষুব্ধ হন। এ নিয়ে দলে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এদিকে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে ব্যর্থতার দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে কোন কোন বিএনপি নেতা ভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমনই এক নেতা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি আন্দোলন করবে জানিয়ে তিনি বলেন আন্দোলন যে রাজপথে গিয়ে করতে হবে এমন কোন কথা নেই। তিনি বলেন, আন্দোলন অনেক রকমের হতে পারে। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা যদি মনে করেন এতদিন তো আমরা সহ্য করেছি আর কতদিন। কিন্তু আমি বলব আমাদের আরও কিছুদিন সহ্য করতে হবে। সময় আসবে, যখন এদেশে সরকার উৎখাত করার জন্য একটি জনবিস্ফোরণ ঘটবে। সম্প্রতি আরেক অনুষ্ঠানে যে কোন মূল্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে কিভাবে মুক্ত করবেন আন্দোলন করে না অন্যভাবে তা তিনি বলেননি। আবার আরেক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, খালেদার মুক্তির জন্য আমরা কিছুই করতে পারিনি। এ কথার মাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, তিনি আন্দোলন করতে চাইলেও অন্যরা রাজি না থাকায় খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কিছুই করা যাচ্ছে না। তিনি এও বলেন, খালেদা জিয়াকে আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করতে না পারা আমাদের দুর্ভাগ্য। আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমাদের অনেক নেতা ঘরে বসে বসে হুঙ্কার দেয় আন্দোলন করে তাঁকে মুক্ত করবেন। কিন্তু তারা রাজপথে নামে না বা নামতে সাহস পায় না। আবার বিএনপিতে কিছু দালাল আছে যারা খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি চায়। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে খালেদা জিয়া বের হবেন কেন? প্যারোল নয়, রাজপথের আন্দোলনেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে। তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কোন নেতার ঘোষণার জন্য বসে না থেকে সবাইকে রাজপথে নামার আহ্বান জানান। আরেক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ছাড়া জাতীয়তাবাদী শক্তি নিথর হয়ে যাচ্ছে। দলের বড় বড় পদধারী নেতাদের সমালোচনা করে গয়েশ্বর বলেন, পদের জন্য চেয়ার দখল করা যাবে, কিন্তু জনগণের মন দখল করা খুব কঠিন। তিনি বলেন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আজকের মতো বিএনপির এত কর্মী ছিল না। কিন্তু আমরা রাজপথ কাঁপিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছিলাম। আজ দলের মধ্যে কত নেতা। কোটিপতি নেতারও অভাব নেই। কিন্তু আজ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জেলে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার।
×