ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্প প্রণয়ন, বিশ্লেষণ, উপস্থাপন ও বাস্তবায়ন

প্রকাশিত: ০৯:১০, ১২ অক্টোবর ২০১৯

 প্রকল্প প্রণয়ন, বিশ্লেষণ, উপস্থাপন ও বাস্তবায়ন

প্রথমত প্রকল্প বলতে আমরা মনে করি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন জরুরী কাজ করা যার কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকে এবং যার ফলে অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। ব্যাপকভাবে বলতে গেলে প্রকল্প একটি সাময়িক উদ্যোগ বা কাজ যার এক বা একাধিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, নির্দিষ্ট এলাকা, উপকারভোগী থাকে এবং এই কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল, আর্থিক সঙ্গতি ও এর সঠিক ব্যবস্থাপনার পরিবেশ থাকে এবং যার ফলাফল পরিমাপ করা যায়। একটি প্রকল্পের ফলাফল স্বল্প মেয়াদি এবং সুদূরপ্রসারী হতে পারে। প্রকল্পের লক্ষ্যে পৌঁছানো পর্যন্ত যত কার্যক্রম সেটির নাম হতে পারে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা। প্রকল্প যেহেতু জনগণের উন্নতিকল্পে হাতে নেওয়া হয় সেহেতু প্রকল্প সঠিক বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প প্রণয়নের সময়, প্রকল্প বাজেট তৈরির সময় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং অভীষ্ট জনগণের প্রতিনিধির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা খুবই জরুরী। কোন কাল্পনিক প্রকল্প হাতে নেওয়া যাবে না। যে বিষয়ের ওপর প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন মনে করেন সেই বিষয়ের ওপর মাঠ সমীক্ষা না করে কোন প্রকল্প ঢাকায় বসে তৈরি করলে মাঠপর্যায়ে অনেক অসঙ্গতি ধরা পড়বে। সেকেন্ডারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোন প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করলে এই প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন অসম্ভব। মাঠ সমীক্ষা ছাড়া মাঠের যাবতীয় তথ্য ছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য দিয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা লেখা সঠিক হবে না। বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দিবে, তখনই ধামাচাপা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে, মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে প্রকল্পের ৪০% উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বাকিগুলো হয়নি। প্রকল্পের ভিন্নতা নির্ভর করে প্রকল্পের বিষয়ের ওপর। ধরুন একটি ২ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ প্রকল্প। এর উদ্দেশ্য কি সকলে অবগত, এখানে হলো যোগাযোগ উন্নয়ন করা যাতে করে কৃষকের পণ্য মার্কেটিং করতে পারে, ছেলেমেয়েরা যাতে নিরাপদে স্কুল কলেজে পরাশোনা করতে যেতে পারে। এই প্রকল্প শেষ হলে ফলাফল দেখা যাবে, কোন কোন প্রকল্প যা চোখে দেখা যায় না। ধরুন একটি বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রকল্প শেষ হলে এর ফলাফল সরাসরি চোখে দেখা যাবে না কিন্তু এর ফলাফল পরবর্তীতে উপলব্ধি করা যাবে। যাদের উন্নয়নের জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হবে তাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে তাদের নিয়ে তাদের অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে প্রকল্প নির্বাচন করে তাদের কাছ থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রকল্প লেখা এবং তদ্রুপ বাস্তবায়ন পরিকল্পনাও তৈরি করতে হবে । তাহলে প্রকল্পটি টিকসই হবে এবং প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে। জনগণের সম্পৃক্ততা শুরু থেকে সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে উপকারভোগীরা যদি ঐ প্রকল্পে কিছু আর্থিক অনুদান বা তার বদলে কায়িক শ্রম দেয় তাহলে প্রকল্পে তাদের মালিকানা আছে মনে করবে এবং প্রকল্প টেকসই হবে। একটি উদাহরণ এখানে প্রণিধানযোগ্য ধরুন পাঁচটি গ্রামে ৫টি নলকূপ বসানোর একটি প্রকল্প শুরু করবেন। প্রতিটি গ্রামে প্রায় ২০টি পরিবার বসবাস করে। প্রতিটি গ্রামে ২০টি পরিবারের প্রধানদের সঙ্গে সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পরিবার পিছু এই নলকূপ বসানোর জন্য ২০% খরচ বহন করবে অর্থাৎ নলকূপটি বসাতে যদি ১০০০ টাকা খরচ হয় সেখানে ২০০ টাকা গ্রামবাসী দেবে অর্থাৎ প্রত্যেকে ১০ টাকা অনুদান দেবে বাকি ৮০০ টাকা সরকার বা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ দেবে। তারপর নলকূপ বসানোর স্থান ঠিক করার জন্য সভা করা হলে সকল সদস্য যে স্থান নির্ধারণ করা হলো তা মেনে নিল। যদি এই ২০০ টাকা অনুদান প্রভাবশালী কোন গ্রামবাসী দিতেন তা হলে তিনি যে জায়গায় স্থান নির্ধারণ করে দিতেন নলকূপ এখানেই বসত। তিনি যদি তার বাড়ির সামনে বসাতে চাইতেন সেখানেই নলকূপ বসত। পরবর্তীতে দেখা যাবে এই নলকূপ তার বাড়ির সীমানায় বেড়া দিয়ে বাড়ির নিজস্ব নলকূপ হিসেবে তিনিই ব্যবহার করবেন আর প্রতিবেশীরা ঐ প্রকল্পের উপকার থেকে বঞ্চিত হবে। তাই যাদের জন্য প্রকল্প তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের চাহিদা প্রকল্প শুরুর পূর্বে স্টাডি করা না হলে প্রকল্পে সময় ও অর্থ খরচ করলেও তা কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। প্রকল্প স্বল্পমেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী যেকোন একটি হতে পারে। মূল বিষয়টি হলো, এটি চিরস্থায়ী বা অনির্দিষ্ট নয় এবং এর কর্মকান্ড ও মেয়াদ সুনির্দিষ্ট। প্রতিষ্ঠান এবং কর্মসূচীর সঙ্গে তুলনা করলেই এর পার্থক্য স্পষ্ট দেখা যায়। গন্তব্যে পৌঁছানো মনে করি প্রকল্পের উদ্দীষ্ট ফল। এই গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত যত প্রচেষ্টা বা আয়োজন, সেটির নাম হতে পারে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা। যিনি সেটি পরিচালনা করেন, তিনি হতে পারেন প্রকল্প ব্যবস্থাপক। প্রকল্প যদি সময় মতো এবং সঠিক বাস্তবায়ন হয় তাহলে প্রকল্পের মেয়াদ অন্তে পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে এবং প্রকল্প চালানোর অর্থের উৎস বন্ধ হলে প্রকল্পের পরিসমাপ্তি হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে, পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পেলে, প্রয়োজনীয়তা না থাকলে; অথবা প্রকল্পের কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পটি আর না চালানোর সিদ্ধান্ত নিলে প্রকল্প বন্ধ হতে পারে। প্রকল্প সাময়িক, কিন্তু এর ফলাফল সাময়িক নয়। একটি প্রকল্পের পরিণতি যুগ যুগ ধরে প্রজন্মান্তরে টিকে থাকতে পারে। একটি উদাহরণ এখানে প্রণিধানযোগ্য তা হলো স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ব্র্যাক ডাইরিয়া আক্রান্ত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা দেয়া শিখানোর জন্য OTEP নামক একটি প্রকল্প শুরু করে এবং যথাসময়ের মধ্যে শেষ করে। কিভাবে এক চিমটি লবণ, এক মুঠো চিনি বা গুড় এবং অর্ধেক লিটার পরিষ্কার পানি দিয়ে লবণ গুড় মিকচার তৈরি করে রোগীকে খাওয়াতে হয় তা শিখানো হয়। প্রতিবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর পর এই মিকচার খাওয়ানো যতক্ষণ না পাতলা পায়খানা বন্ধ না হয়। বাংলাদেশের গ্রামের ১০০% মা বোনদের কাছে এই তথ্যটি পৌঁছে দেওয়া হয়। এটা ব্র্যাকের একটি একশত ভাগ কার্যকরী সফল প্রকল্প ছিল যার ফল দেশের গরিব মানুষ ভোগ করছে। এই প্রকল্পের মেয়াদকাল যদিও স্বল্প ছিল কিন্তু এর ফলাফল দেশের মানুষ সারা জীবন ভোগ করবে অর্থাৎ এই প্রকল্পের ফলাফল সুদূরপ্রসারী ছিল। প্রকল্প দৈনন্দিন কার্যক্রম থেকে আলাদা। প্রকল্প সাময়িক, কিন্তু অপারেশনস চলমান। প্রকল্প নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ হয়ে যায়, অপারেশনস পৌনপুনিক। উদ্দেশ্য, কাজ এবং কৌশলের দিক দিয়ে প্রাত্যহিক কাজের সঙ্গে প্রকল্পকে মেলানো যায় না। কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য, সমস্যা বা ফলাফলকে লক্ষ্য করে প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কার্যক্রম পরিচালিত হয়। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এবং অংশগ্রহণকারীকে কেন্দ্র করে প্রকল্প পরিকল্পিত হয় বলে এর বাস্তবায়নের জন্য বিশেষায়িত জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কাজের লক্ষ্য হলো কাজটি সঠিকভাবে করা বা চালিয়ে যাওয়া, কিন্তু প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো দ্বিমুখী, কাজটি সঠিকভাবে শুরু করা। প্রকল্প ও কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ভূমিকাগুলো আলাদাভাবে বিবেচনা করলে এসব পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে আরেক প্রকল্পের কথা উল্লেখ করছি যে প্রকল্পটি কারিতাস নামক একটি জাতীয় বেসরকারী সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়, প্রকল্পটির নাম ছিল ডিডস (DEEDS)- Development Extension Education Service, যাকে বাংলায় বলা হতো উন্নয়ন শিক্ষা সম্প্রসারণ কার্যক্রম। এই প্রকল্প ১৬ বছর চলমান ছিল। সেই প্রকল্পে শুরু থেকেই গ্রামভিত্তিক ভূমিহীন পুরুষ এবং মহিলাদের নিয়ে ২০ সদস্যবিশিষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে সংঘটিত করে দলের প্রথম এবং দ্বিতীয় সারির নেতাদের নিয়ে উপজেলাভিত্তিক একটি বৃহত্তর সংগঠন গঠন করা হতো, যাকে বলা হতো এ্যাপেক্স বা বৃহত্তর সংগঠন। এই বৃহত্তর সংগঠন গ্রামীণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলকে কিভাবে পরিচালিত করবে তার ওপর বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, গ্রামভিত্তিক এই দল গঠন করে বৃহত্তর সংগঠন গঠন করতে ১২ বছর সময় লেগে যায়, এই রকম ৬টি উপজেলায় প্রথমে ঢাকা কারিতাস আঞ্চলিক অফিসের তত্ত্বাবধানে এই এ্যাপেক্স গঠিত হয়। একদিকে চলছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামীণ দলকে পরিপক্ব করে তুলার জন্য প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের পাশাপাশি এপেক্স সংগঠনকেও পরিপক্ব করে তুলার জন্য যাবতীয় কার্যক্রম। এ্যাপেক্স সংগঠন পরিচালনার জন্য তাদের দ্বারা একটি সংবিধান তৈরি করা হয়। যখন দল পরিপক্ব হয়ে ওঠে এবং এ্যাপেক্সও পরিপক্ব হয়ে ওঠে তখন এই এ্যাপেক্স সংগঠনকে একটি মূলধন দিয়ে কারিতাস এই উপজেলায় এ কর্মসূচী থেকে তার অন্য সব কার্যক্রম উঠিয়ে নেয়। তারপর দূর থেকে এই এ্যাপেক্সকে সহায়তা দেয়, যখন কোন সমস্যা দেখা দেয় তখন কারিতাস সহযোগিতা করে। এখন এই সংগঠন নিজেরা নিজেরাই দলগুলো পরিচালনাসহ নানা উন্নয়ন কর্মসূচী হাতে নিচ্ছে। তাদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে কারও সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল কয়েকটি উপজেলার ভূমিহীন পুরুষ এবং মহিলাদের সংঘটিত করে উন্নয়ন শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ করে তাদের উন্নয়নে যেন তারা নিজেরা অংশগ্রহণ করতে পারে সেই লক্ষ্যে গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল তৈরি করে ঐ দলগুলোর প্রথম এবং দ্বিতীয় সারির নেতাদের নিয়ে উপজেলা ভিত্তিক বৃহত্তর সংগঠন গড়ে তোলা। নিজেদের বৃহত্তর সংগঠন গড়ে তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সহায়তা করা। এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষে গঠিত বৃহত্তর সংঘটন উপজেলাভিতিক গঠিত হয় এবং সেগুলো নিজেদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এবং নিজেরা এর সুবিধা ভোগ করছে অর্থাৎ এই প্রকল্প একটি টেকসই প্রকল্প হিসেবে জনগণের কাছে টিকে থাকবে যদিও মূল প্রকল্পটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন যান্ত্রিক প্রকৌশলী হেনরি লরেন্স গান্টকে প্রকল্প ব্যবস্থাপনার জনক বলা হয়। প্রকল্প পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং নিয়ন্ত্রণের কিছু জনপ্রিয় কৌশল আবিষ্কার করেন মিস্টার গান্ট। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তিনি গান্ট চার্টের প্রবর্তন করেন। ব্যবস্থাপনার কাজকে সকলের জন্য সহজতর করে দেন। বর্তমানে আরও ব্যাপক গবেষণার ফল হিসেবে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবিধার্তে গ্যাঁট চার্ট তৈরি করে সময়মতো অনুসরণ করলে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চিত হওয়া যাবে। প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিতকরণ অথবা প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজন আছে কিনা যাচাই করা। সম্ভাব্য সমাধানের উপায় নির্ধারণ করা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের উৎস আছে কিনা, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিশেষজ্ঞ পাওয়া যাবে কিনা এবং প্রকল্প যারা বাস্তবায়ন করবেন তাদের প্রকল্প সম্পর্কে ধারণা থাকা খুবই জরুরী। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ এবং পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। প্রকল্পে নিয়োজিত সকলের মধ্যে টিম স্পিরিট থাকতে হবে তা না হলে প্রকল্পে মাঠপর্যায়ে ভুল তথ্য যেতে পারে ফলে সঠিক বাস্তবায়ন নাও হতে পারে। প্রকল্পে নিয়োগ হবে চুক্তিভিত্তিক, কোন স্থায়ী কর্মকর্তাকে অন্য স্থান থেকে সাময়িক প্রকল্পে নিয়োগ করা যাবে না। কোন কিছু গোপনীয় করে রাখা যাবে না। সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা অবলম্বন করতে হবে। কোন রকম অনিয়ম প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। উপর থেকে বা দাতা সংস্থা কর্তৃক কোন ধারণা বা মাঠ যাচাই বাছাই না করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া সমীচীন হবে না। যাদের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, প্রকল্পের ধারণা যদি তাদের কাছ থেকে আসে তা হলে তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা থাকে শতভাগ। কারণ একটি এলাকায় কোন প্রকল্প প্রয়োজন এবং প্রকল্পটি বাস্তবায়ন যোগ্য। এই প্রকল্প সাধারন মানুষের উপকারে আসবে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো স্থানীয় মানুষ ছাড়া অন্য কোন আগন্তুক জানবেন না। তাই অংশগ্রহণকারীদের মতামত নিয়ে প্রকল্প চূড়ান্ত করতে হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য মাঝামাঝি সময় মূল্যায়ন করা দরকার তাতে জানা যাবে কোন বিচ্যুতি ঘটেছে কিনা বা সঠিক দিকে যাচ্ছে কিনা। যদি কোন ও ভুল হয়ে থাকে বা কোন বিচ্যুতি হয়ে থাকে তখন তা সংশোধন করা যাবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করা একটি চলমান প্রক্রিয়া, এবং ব্যবস্থাপক কে নিয়মিত ফিডব্যাক দিতে হবে যাতে করে কোন শূন্যতা দেখা দিলে পূরণ করা যায় । মনিটরিং সঠিক ভাবে করার জন্য রিপোর্টিং পদ্ধতি উন্নয়ন করতে হবে। প্রকল্প মনিটরিং অফিসে বসে করা যায় এবং মাঠে গিয়েও মাঠ পরিদর্শন করে করা যায়। প্রকল্প বাস্তবসম্মত হলে প্রকল্প অফিস ঢাকাতে না রেখে জেলা পর্যায়ে করা যায় কিনা তা যাচাই করে দেখতে হবে। প্রকল্পের হেড অফিস জেলা পর্যায়ে হলে অনেক সময়ের সাশ্রয় হবে এবং মনিটরিং করারও সুবিধা হবে। প্রকল্পের ধরন অনুযায়ী প্রকল্পের ত্রৈ-মাসিক অথবা সান্মাসিক প্রতিবেদন ফর্ম বাস্তবায়নকারীগণ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করবেন এবং সমস্যা সমাধানের সুপারিশ করবেন। অগ্রগতি প্রতিবেদনে এ প্রকল্পের সকল অগ্রগতির বিষয় উল্লেখ থাকবে । প্রতিবেদন তৈরি করবেন সরাসরি যারা মাঠে কাজ করবেন তারা। একটি প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে এই প্রকল্পের পরিচালকের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সঠিকভাবে পরিচালনার উপর। এখানে উল্লেখ থাকবে কোন কাজটি কখন করা হবে, কে এই কাজ করবেন এবং কত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। কর্মীদের সভায় কর্ম পরিকল্পনার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করতে হবে এবং কর্ম পরিকল্পনায় উল্লেখিত কোন কাজ যদি করা সম্ভব না হয় তাহলে আলোচনা করে উক্ত কাজটি যথাসম্ভব দ্রুত সমাপ্ত করতে হবে, ফেলে রাখা যাবেনা। প্রকল্পের সকল কর্মীদের নিয়ে প্রতি ২ মাস পর পর প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ে একটি সভা পরিচালনা করবেন প্রকল্প পরিচালক। প্রকল্প পরিচালকের সাথে সহযোগিতা করবেন বিশেষজ্ঞগন। সভায় আলোচিত সমস্যা সমাধান এবং সিদ্ধান্ত একজন লিপিবদ্ধ করবেন এবং লিখিত প্রতিবেদন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সকল কর্মীদের হাতে পৌঁছে দিবেন। পরবর্তী সভায় সকলে বিগত সভার প্রতিবেদন সাথে নিয়ে আসবেন এবং সভার পরিচালক প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত সঠিক বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা তা ফলোআপ করবেন। আলোচনায় কোনো সমস্যা আসলে সমাধান দিবেন। প্রকল্প পরিচালক এই কর্মী সভার আলচ্যসূচি তৈরি করে সভার ১৫ দিন পূর্বে কর্মীগনের হাতে পৌঁছে দিবেন। প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে বাজেট বিন্যাস করা। কারন প্রতিটি কাজের জন্য অর্থের প্রয়োজন। প্রকল্পের অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একটি প্রকল্পের মোট বাজেটের শতকরা ১৮% এর বেশী প্রশাসনিক ব্যয় ধরা যাবে না। প্রকল্পের জনবলের জন্য ৩০% এর বেশী বাজেট রাখা যাবে না । বাকি ৬০% অর্থ রাখতে হবে প্রকল্পের অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর কাজের জন্য। প্রকল্প দীর্ঘ মেয়াদি হলে কিছু অর্থ ক্যাপিটেল বাজেট হিসাবে রাখা যাবে। প্রকল্পের আর্থিক ম্যানেজমেন্ট সঠিকভাবে সচ্ছতার সাথে করতে হবে। মনে রাখবেন কোন প্রকল্পে যদি অর্থ নিয়ন্ত্রন সঠিক থাকে সেই প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন হয়, তাই নিয়মিত খরচের হিসাব প্রতিদিন খাতায় সঠিক ভাবে লিখে রাখতে হবে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে ইন্টারনাল অডিট করে হিসাব বন্ধ করে দিতে হবে । যে কোন প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে ঐ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা অপরিহার্য। অন্যথায় প্রকল্পটি হয়ত বাস্তবায়ন হবে কিন্ত সাধারন মানুষের কাজে আসবে না। ধরুন কমলগঞ্জ উপজেলায় একটি বাইসাইকেল তৈরির কারখানা স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হলো। তার আগে কোন সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। এই প্রকল্প শুরুর আগে যে বিষয়গুলো দেখার কথা ছিল তা হল সাইকেল তৈরির কাঁচামাল ঐ এলাকায় পাওয়া যাবে কিনা,সাইকেল তৈরির জন্য দক্ষ জনবল পাওয়া যাবে কিনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন, কারখানা তৈরির জন্য জায়গা পাওয়া যাবে কিনা ইত্যাদি। সম্ভাব্যতার উপর নির্ভর করবে প্রকল্প কতটুকু সফল হবে। উক্ত বিষয়গুলো যাচাই করে দেখা গেল কমলগঞ্জে সাইকেল তৈরির কাঁচামাল পাওয়া যায় না, দক্ষ জনবল নেই, তাই এই এলাকায় সাইকেল তৈরির কারখানা করা যুক্তিযুক্ত হবে না। প্রকল্প শেষ হলে অভিজ্ঞ ৩ সদস্য বিশিষ্ট টিম গঠন করে প্রকল্পের অফিস পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত কাজ বাস্তবায়নের উপর একটি মুল্যায়ন প্রতিবেদন করা যেতে পারে। যেখানে থাকবে প্রকল্পের সকল সবল ও দুর্বল দিকগুলো এবং এই টিম কর্তৃক কোন সুপারিশ থাকলে সেগুলোও তারা উল্লেখ করবেন । লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×