ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাঙছে বিদ্যুত বিতরণে ১২২ বছরের প্রথা

দেশে প্রথমবারের মতো স্মার্ট গ্রিড নির্মাণ করছে ডিপিডিসি

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২ এপ্রিল ২০১৮

দেশে প্রথমবারের মতো স্মার্ট গ্রিড  নির্মাণ করছে ডিপিডিসি

রশিদ মামুন ॥ বিদ্যুত বিতরণে ১২২ বছরের প্রথা ভেঙ্গে দেশে প্রথমবারের মতো স্মার্ট গ্রিড নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) রাজধানীর মধ্যভাগের কিছু অংশে আধুনিক এই বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যাচ্ছে। তবে এটিকে পাইলট প্রকল্প বলছে বিতরণ কোম্পানিটি। ভবিষ্যতে এই প্রকল্পের সুফল বিবেচনায় নতুন এলাকায় স্মার্ট গ্রিডে বিদ্যুত বিতরণ শুরুর চিন্তা রয়েছে ডিপিডিসির। সারাদেশে দুই কোটি ২০ লাখের মতো বিদ্যুত গ্রাহক রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকলের ঘরেই বিদ্যুত দিতে যাচ্ছে সরকার। বিদ্যুত বিভাগ দাবি করছে সারাদেশের অন্তত ৮০ ভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছেছে। আরও ২০ ভাগ মানুষের ঘরে ’২১ সালের মধ্যে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। দেশে এখন পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির পাশাপাশি বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুত বিতরণ করছে। এতে কোন কোম্পানিই এখনও পর্যন্ত স্মার্ট গ্রিডের কোন প্রকল্প হাতে নেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে আধুনিক এই বিতরণ ব্যবস্থায় বিদ্যুত সরবরাহের তাগিদ রয়েছে। তবে পুরাতন বিতরণ ব্যবস্থার বদলে নতুন করে সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরির ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের দরকার হবে, যা বিতরণ কোম্পানির একার পক্ষে বহন করা কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিতরণ ব্যবস্থার সব শেষ প্রযুক্তি হচ্ছে স্মার্ট গ্রিড। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে একজন গ্রাহক নিজে যেমন তার বিদ্যুত ব্যবহার তদারকি করতে পারবেন একইভাবে বিতরণ ব্যবস্থাও আধুনিক এবং ত্রুটিহীন করা সম্ভব। এখন বিতরণ ত্রুটি খুঁজে পেতে সময় ব্যয় করতে হয়। কিন্তু আধুনিক এই পদ্ধতিতে এক জায়গায় বসেই ত্রুটি চিহ্নিত করার পাশাপাশি সারানো যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন দুর্ঘটনায় যদি একটি বাড়ি বা এলাকার বিদ্যুত ব্যবস্থা বিকল হয়ে যায় তবে সেন্সর ও স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে স্মার্ট গ্রিড খুব সহজেই এই সমস্যা বুঝতে পাারবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমস্যাকে সমাধান করতে পারবে। একটি এলাকার দুর্ঘটনার কারণে অন্য এলাকার বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার যেন ক্ষতি না হয়, স্মার্ট গ্রিড সে বিষয়ে সাহায্য করবে। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীর ধানম-ি, আজিমপুর, গ্রীন রোড, লালমাটিয়া ও আসাদগেট এলাকায় দেশের প্রথম স্মার্ট গ্রিড নির্মাণের পরিকল্পনা করছে তারা। এজন্য এই পাঁচটি এলাকায় নতুন সাবস্টেশন নির্মাণ করা হবে। এতে ফরাসী উন্নয়ন সংস্থা ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এফডিএ) ১২ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদানের প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে। সম্প্রতি এফডিএর একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে। ওই প্রতিনিধি দল ঢাকার বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থা ঘুরে দেখে। একই সময়ে স্মার্ট গ্রিড করার বিষয়ে ডিপিডিসি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে বিদ্যুত সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস ছাড়াও বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিকাশ দেওয়ান বলেন, বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ডিপিডিসির অন্য একটি প্রকল্পে এফডিএ ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। একই সঙ্গে স্মার্ট গ্রিডে তাদের কাছে অনুদান চাইলে প্রাথমিকভাবে ১২ মিলিয়ন দেয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে ডিপিডিসির সম্পূর্ণ বিতরণ ব্যবস্থা স্মার্ট গ্রিডের আওতায় আনতে বিপুল বিনিয়োগ দরকার। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে তা করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা ইতোমধ্যে শেষ করেছে ডিপিডিসি। পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক আনন্দবাজারের একটি খবরে বলা হয়, বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিক এই প্রকল্প গুজরাটের আহমেদাবাদ এবং পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়িতে প্রথম বাস্তবায়ন হয়েছে। এছাড়া উপমহাদেশের কোথাও স্মার্ট গ্রিডে বিদ্যুত বিতরণ হচ্ছে না। জানা গেছে স্মার্ট গ্রিড প্রথায় গ্রাহক মোবাইলের ‘প্ল্যানের’ মতোই নিজের বিদ্যুত ‘প্ল্যান’ বেছে নিতে পারবেন। তৈরি হবে একটি আধুনিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। বাড়ি বা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের মিটার বক্সে ‘সিম কার্ডের’ মতো কার্ড থাকবে। যে কার্ডের মাধ্যমে ১৫ মিনিট অন্তর কী পরিমাণ বিদ্যুত খরচ হয়েছে তার তথ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পৌঁছে যাবে। চাহিদা কমে গেলে বা বৃদ্ধি পেলে আপনাআপনি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এই পদ্ধতি শিল্প ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক বলে মনে করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ স্মার্ট গ্রিড প্রবর্তনের শুরুতে শিল্প এলাকা দিয়ে শুরু করেছিল। তবে সারাদেশে স্মার্ট গ্রিডের প্রবর্তন করা সম্ভব হলে পিক (সর্বোচ্চ চাহিদার সময়) এবং অফপিক (সর্বনি¤œ চাহিদার সময়) বিদ্যুতের দামও পৃথকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব। এতে গ্রাহক মূল্য বিবেচনা করে বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। জানা যায়, বিশে^র অনেক দেশ ইতোমধ্যে স্মার্ট গ্রিডে বিদ্যুত সরবরাহের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশে^র মধ্যে ২০০৫ সালে প্রথম স্মার্ট গ্রিড প্রয়োগ করা হয় ইতালিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বছরে ৫০০ মিলিয়ন ইউরো সাশ্রয় হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সরকার ২০০৯ সালে স্মার্ট গ্রিড প্রয়োগের জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা এই প্রকল্পটির নাম দিয়েছে এনার্জি অস্ট্রেলিয়া। কানাডা ২০০৬ সালে দেশটির বিতরণ ব্যবস্থায় স্মার্ট গ্রিড ব্যবহারের ঘোষণা দেয়। আমেরিকা ২০০৭ সালে স্মার্ট গ্রিড ব্যবহারের পদক্ষেপ শুরু করে। প্রতি বছর তারা ১০০ মিলিয়ন ডলার এই খাতে বিনিয়োগ করার লক্ষ্য নিয়েছে। আধুনিক এই বিতরণ ব্যবস্থার সঙ্গে চীন ২০০৯ সালে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ২০০৫ সালে, দক্ষিণ কোরিয়া ২০৩০ সাল নাগাদ স্মার্ট গ্রিডে বিদ্যুত সরবরাহের ঘোষণা দেয়। আর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ঘোষণা দেয় গত বছর। বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সম্প্রতি বলেন, দিন দিন আমাদের বিতরণ ব্যবস্থার আওতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে আমাদের বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিক করতে হবে। সরকার এক্ষেত্রে স্মার্ট গ্রিডে বিদ্যুত বিতরণের চিন্তা করছে।
×