ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

হাঁড়ি ভর্তি খেজুরের রস, চুরি করে খাওয়ার মধুর স্মৃতি ব্যতিক্রমী মেলা চারুকলায়

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ২০ জানুয়ারি ২০১৮

হাঁড়ি ভর্তি খেজুরের রস, চুরি করে খাওয়ার মধুর স্মৃতি ব্যতিক্রমী মেলা চারুকলায়

মোরসালিন মিজান ॥ সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা পান। অন্যের আচার বেশ রপ্ত করেছে বাঙালী। তবে উল্টোটি ঘটলো শুক্রবার। এদিন বেশ মার খেল শহুরে সংস্কৃতি। যান্ত্রিক নগরীতে ফিরে এলো গ্রাম। প্রিয় শৈশব কথা বললো। সবই হলো রসেরমেলায়। রস মানে, খেজুরের রস। শুক্রবার চারুকলার বকুলতলায় ব্যতিক্রমী এ মেলার আয়োজন করে ‘রঙ্গে ভার বঙ্গ’ নামের একটি সংগঠন। একেবারে নতুন নয়। এর আগে ৬ বার আয়োজন করা হয়েছে। গত বছর থেকে এটি চলে আসে চারুকলার বকুলতলায়। এবার সপ্তম বর্ষ। ঘটা করে প্রচার করা বলতে যা বোঝায় সেটি হয় না, হয় নি। এর পরও ছুটির দিনে বহু মানুষ আগেভাগে ঘুম থেকে ওঠেছিলেন। চলে এসেছিলেন মেলায়। সামান্য আয়োজন। এক গ্লাস রসে গলা ভেজে না। মন ভরে যায় ঠিকই! কী যে আগ্রহ নিয়ে পান করলেন সবাই! আবেগ উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। বলার অপেক্ষা রাখে না, শীতের প্রধানতম আকর্ষণ খেজুরের রস। বাংলাদেশে খেজুর নেই। রসটাই মজা করে পান করে বাঙালী। আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ শুরু হয়। বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলে রস সংগ্রহের কাজ। আবহাওয়া ঠা-া, আকাশ মেঘলা ও কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে রস বেশি পাওয়া যায়। স্বাদও হয় বেশি। পৌষ-মাঘ মাসে তাই সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। এখন সে সময়। মাঘের শুরুতে ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে রস সংগ্রহ করেন আয়োজকরা। সকাল ৮টায় শুরু হয় মেলা। এ সময় বকুলতলা ঘুরে দেখা যায় উৎসবের আমেজ। জয়নুল গ্যালারি সংলগ্ন খোলা জায়গায় লম্বা টেবিল পাতা হয়েছিল। উপরে খেজুরের রস ভর্তি হাঁড়ি। চত্বরে প্রবেশ করেই সেদিকে ছুটছিলেন সবাই। রস কিনে পান করছিলেন। অনেকে এক চুমুকেই গ্লাস শেষ করে ফেলেছেন। কেউ কেউ ছোট হাঁড়ি শূন্যে তুলে ধরে মুখের উপর ঢেলে দিয়েছেন। খেজুরের রসে ভেজানো চিতই ছিল। ছিল গুড় মুড়িও। যার যা পছন্দ খাচ্ছিলেন। ততক্ষণে প্রস্তুত হয়ে গেছে মঞ্চ। খেজুরের রস ভর্তি কলস দিয়ে সাজানো মঞ্চে সুর তুলেছে লোক বাদ্যযন্ত্র। ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা,/এই যমুনা সুরমা নদী তটে...। হ্যাঁ, চমৎকার দেশ বন্দনা দিয়ে শুরু। পরে চিরায়ত বাংলাকে গানে গানে তুলে ধরেন জনি বয়াতি। একটু ভিন্ন ধারার গান। গ্রামীণ জীবন, জীবনে আসা প্রেম ও বিচ্ছেদ গল্প। একটি গানের কথা এরকম- আছি কিংবা মইরা গেছি/একটু নাহি ফিরা চায়/ বন্ধু আমার হাওয়াই মিঠাই ফড়ফড়াইয়া উইড়া যায়...। অপর গানে প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে মিলনের আশা। বয়াতি গেয়ে যানÑ বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি রে/ মধ্যে প্রেমের নদী/ উইড়া যাইতে দেয় নাই পাখা রে...। এভাবে গোটা পরিবেশটাই আপন হয়ে ওঠে। মেলায় খেজুরের রসপানের স্মৃতি তুলে ধরেন বিশিষ্টজনেরা। নিজের মাটির গ্লাসে চুমুক দিয়ে আয়োজক সংগঠনের সভাপতি হায়াৎ মামুদ বলেন, এটা প্রতিকী অনুষ্ঠান। এ মরসুমে সব গ্রামেই খেজুরের রস খাওয়ার চল আছে। আমরা ছোটবেলায় চুরি করে রস খেয়েছি। আজকের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা ফেলে আসা গ্রামের কথা মনে করছি। শৈশবে ফিরে যাচ্ছি। ঢাকায় খেজুরের রস দুর্লভ। কোথায় পাওয়া যায়, কে তার খবর রাখে? এ অবস্থায় মেলায় এসে অনেকেই বহুকাল পর রস পান করেছেন। একটু গলা ভেজানোর সুযোগ। তাতে কী দারুণ একটা অনুভূতি! আক্তারী মমতাজ বলছিলেন সেই কথা। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব বলেন, সেই কবে খেজুরের রস খেয়েছিলাম! বহু বছর পর এখানে এসে আবার স্বাদ নিলাম। রসের মেলা আমাদের ছোট বেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। শীতের সময় নানাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম। ভোর বেলা গাছ থেকে রস নামিয়ে আমাদের খেতে দেয়া হত। রসের চা হতো। পায়েশ হতো। স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে সকলকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। শাহিদা বেগমও শৈশবে ফিরে যান। বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের পরিচালক বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি দক্ষিণবঙ্গে। আমরা মেয়েরাও গাছে ওঠে চুরি করে খেজুরের রস খেয়েছি। পুকুরপাড়ে কলপাড়ে অনেক খেজুর গাছ ছিল। বিকেলে গাছিরা সেগুলোতে ভাঁড় বেঁধে রেখে যেত। আমরা মাটির ভাঁড় ছিদ্র করে পাটকাঠি দিয়ে রস টেনে খেয়েছি। পরে আঠাগুলো ছিদ্র বন্ধ করেছি যাতে কেউ টের না পায়। বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতি কোন ঠুনকো কথা নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, খেজুরের রস সেই সংস্কৃতির একটি অনুষঙ্গ। এই রসে পিঠাপুলি হয়। আমরা খেজুরের রসে ভিজিয়ে চিতই পিঠা খেয়েছি। গুড় মুড়ি দিয়ে সকালে নাস্তা করেছি। বর্তমানের আলোচনায় এসে তিনি বলেন, আজকের প্রজন্ম এমন অনেক স্মৃতি থেকে বঞ্চিত। তারা কোল্ড ড্রিঙ্কস খায়। এর ফলে বাঙালীর নিজস্ব অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতির লালন ও চর্চার উপর জোর দেন তিনি। পরে মেলায় উপস্থিত সকলকে খেজুরের রস দিয়ে আপ্যায়ন করেন আয়োজকরা। এ সময় কথা হয় মূল আয়োজক ইমরান উজ-জামানের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাঙালীর মনে রসবোধটা সবসময়ই ছিল। আমরা সেটিকে একটু জাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি বলতে পারেন। গ্রামীণ জীবন, ভুলে থাকা নিজের সংস্কৃতিকে শহুরে প্রজন্মের সামনে তুলে ধরাই আমাদের লক্ষ্য। এবারও মেলা উপলক্ষে কয়েক মন রস সংগ্রহ করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, খেজুরের গাছ কমে যাচ্ছে। গাছি পাওয়া যায় না। আরও কিছু সমস্যা আছে। এগুলো দূর করা গেলে বাঙালীর রসেরমেলা আরও জমবে বলে মনে করেন তিনি।
×