ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ শতক ॥ নীল তিমি নীল বিষ

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২২ অক্টোবর ২০১৭

একুশ শতক ॥ নীল তিমি নীল বিষ

ব্লু হোয়েল নামক একটি অনলাইন গেম নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মূলস্রোতের গণমাধ্যম এমনকি আদালত পর্যন্ত আলোচিত হয়ে আসছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত মধ্যরাতে টেলিকম অপারেটরগুলোর বিনামূল্যের ইন্টারনেট সেবাকে ৬ মাসের জন্য বন্ধ করতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছে। সম্প্রতি ঢাকার স্বর্ণা নামক একটি মেধাবী মেয়ের আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনার সূচনা হয়। আমরা এর আগে এমন কোন গেমের নামও হয়তো শুনিনি। তবে স্বর্ণার খবরটি প্রচারের পর দেশের নানা স্থান থেকে হাতে রক্ত দিয়ে তিমি আঁকা, হাত কাটা, অসুস্থ বা আহত হবার এমন অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। যদিও আলোচনাটি আপাতত স্তিমিত হয়ে এসেছে তথাপি কিছুটা আতঙ্ক, কিছুটা ভয়, কিছুটা আগ্রহ এখনও বিরাজ করে। ব্লু হোয়েল সম্পর্কে সাধারণ তথ্য হলো এটি একটি অনলাইন গেম। নীল তিমি এক সময়ে সমুদ্র থেকে ডাঙ্গায় ওঠে আসে যাকে অনেকে মনে করেন যে মাছটি আত্মহত্যা করার জন্যই ডাঙ্গায় আসে সেজন্য ব্লু হোয়েল গেমটিকে আত্মহত্যা গেম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একজন রুশ তরুণ যার নাম বুদেকিন সে ২০১৩ সালে গেমটি উদ্ভাবন করে। ২০১৬ সাল থেকে এটি বেশি প্রচলিত হয় এবং দুনিয়ার শতাধিক কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী এই গেম খেলে আত্মহত্যা করেছে বলে মনে করা হয়। এর সংক্রমণ রাশিয়াতেই প্রবল হয় বলে গেমটির উদ্ভাবককে রুশ সরকার গ্রেফতার করেছে এবং গেমটির মূল সার্ভার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যাদেরকে ‘এই গেম খেলে আত্মহত্যা করেছে’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের কারও আত্মহত্যার নিশ্চিত কারণ হিসেবে পুলিশ এই গেমটিকে শনাক্ত করতে পারেনি। আমার নিজের ধারণা এখনও যারা ব্লু হোয়েল গেম খেলে তারা মূল গেমটির ক্লোন বা ভিন্ন সংস্করণ কিংবা নবায়িত সংস্করণ খেলে। এর প্রধানতম কারণ মূল নায়ক ও তার উদ্ভাবন এখন কারাগারে বন্দী। তবে আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত যে, ব্লু হোয়েল জাতীয় গেম বাংলাদেশেও কেউ কেউ খেলে থাকে। আসলে এ গেমটি কি ধরনের এবং কিভাবে খেলে তা ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে। এখন পর্যন্ত আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- এটি সত্যিই এমন একটি গেম যা ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায়। এর ৫০টি ধাপের মধ্যে প্রথম দিকের গেমগুলো এডভেঞ্চারমূলক হলেও শেষ দিকের ধাপগুলো হয় অনেক বেশি ক্ষতিকর। গেমাররা এতে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন। তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলেন। তাদের দেয়া তথ্য ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ারও হতে পারে। গেমের ডিজাইনটাই এমনভাবে করা হয়েছে। কারণ, গেমটি যে তৈরি করেছে সে মনোবিজ্ঞানে পারদর্শী। গেম উদ্ভাবনের প্রধান কারণ হিসেবে এর উদ্ভাবক জানিয়েছে যে, সে দুনিয়াতে হতাশ ও উদ্যমহীন মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। তার মতে এদের মরে যাওয়াই ভালো। সে গেম খেলিয়ে তাদেরকে আত্মহত্যার পথে নিতে চায়। আমরা যারা সাধারণভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করি তারা জানি না, ইন্টারনেটের দুটি দিক আছে। একটি দিক হলো আমরা যা ব্যবহার করি সেটি। অন্যটিকে বলা হয় ডার্ক ওয়েব। সাধারণ মানুষ ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করতেই স্বচ্ছন্দ্য নয়। সেই ডার্ক ওয়েবের গেম হলো ব্লু হোয়েল। ডার্ক ওয়েবে মাদক, অস্ত্র ব্যবসা, পর্নোগ্রাফিসহ সকল খারাপ বস্তুর ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। দুনিয়ার খুব কম সরকারই সেই জগতে প্রবেশাধিকার রাখে। আমাদের দেশের জন্য ইন্টারনেট নামক পুরো বিষয়টাই অত্যন্ত নাজুক। আমরা ইন্টারনেট বন্ধ করি, ফেসবুক বন্ধ করি, তরুণ-তরুণীদের ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখি, গেম খেলতে দিই না। অভিভাবক ও নীতি নির্ধারকরা একটাই উপায় জানেন কেমন করে ইন্টারনেট আর গেম থেকে দূরে রেখে তাদের সন্তানকে রক্ষা করা যায়। ইন্টারনেট দুনিয়াটিকে যে তালা মেরে রাখা যায় না, এটি যে বালির নিচে মাথা লুকিয়ে মনে করা যে দুনিয়া আমাকে দেখে না সেটি বোঝানো দায় হয়ে পড়েছে। এটিও আরও হতাশাজনক যে, শিক্ষক শিক্ষয়িত্রী এবং আমাদের প্রশাসনিক কর্তারাও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ইন্টারনেট ও গেম খেলা বন্ধ রাখার পক্ষে। আমার মতে, মাথাব্যথা হলে মানুষ মাথা কেটে ফেলে না, চিকিৎসা করে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও এমনটাই করতে হবে। যেহেতু ‘ব্লু হোয়েল’ বা ইন্টারনেটের অন্ধকার দিকগুলো সমস্যা, তাই এর সমাধান করতে হবে। আমি আগেই বলেছি যে, ইন্টারনেটে ‘ডার্ক ওয়েব’ বলতে একটা বিষয় আছে। অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, জুয়া ও পর্নোগ্রাফিসহ অপরাধ জগতের অনেক কিছুই সেখানে থাকে, যা তরুণ-তরুণীদের বিপথে নিয়ে যেতে পারে। সেই জগতে বিট কয়েন নামক অবৈধ কারেন্সিও আছে। এসবের ভয়ে কি আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহার ছেড়ে দিতে হবে? ছেড়ে দিতে হবে গেম খেলা? ব্লু হোয়েলের ক্ষেত্রে একই কথা। ইন্টারনেট বন্ধ করতে হবে কেন? ইন্টারনেট বন্ধ করা মানে একটা ছেলে বা একটা মেয়ের ভবিষ্যত চিন্তাকে আটকে দেয়া। কর্মক্ষেত্রে তাকে পিছিয়ে দেয়া। বিশ্বের বৃহত্তম জ্ঞানভা-ার থেকে নতুন প্রজন্মসহ দেশটিকে দূরে সরানো। একটা সময় আসবে যখন প্রযুক্তি না জানলে পিয়ন কিংবা ঝাড়–দারের চাকরিও পাওয়া যাবে না। সুতরাং একেবারে বন্ধ না করে খারাপটা যাতে কেউ গ্রহণ না করে বা ক্ষতিকর কোন বিষয় ছড়িয়ে না পড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে। ইন্টারনেট তো এখন অধিকাংশ ছেলেমেয়েই ব্যবহার করে। তার মধ্যে খারাপ হয় দু-এক জন। আমার নিজের ছেলেমেয়ের হাতেও আমি অবাধ ইন্টারনেট দিয়েছি। তারা তো কেউ খারাপ হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে ব্লু হোয়েলের মতো ক্ষতিকর বিষয়গুলোকে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়? সমাজে অনেক অপরাধই কিন্তু হয়। সেগুলোর ক্ষেত্রে প্রথম কথা যেমন সচেতনতা, তেমনি ‘ব্লু হোয়েল’সহ ইন্টারনেটভিত্তিক যত অপরাধ ও সমস্যা রয়েছে তারও প্রথম সমাধান সচেতনতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞানতার জন্য এই অন্ধকার জগতে মানুষ প্রবেশ করে। আমরা ইন্টারনেটি শিক্ষিত নই বলে নিজেরা জানি না কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়। এজন্য অপরাধের সঙ্গী হওয়া থেকে প্রতারিত হওয়াটাই অজ্ঞানতার জন্যই হয়। ফলে আমার প্রথম পরামর্শ ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় এর ভাল মন্দ জেনে নিন। এর বাইরেও এক্ষেত্রে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হবে। তারমধ্যে প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো ‘পরিবার’। পরিবার থেকে ছেলেমেয়েদের সচেতন করতে হবে, তাদের খোঁজখবর রাখতে হবে। বাবা-মা সন্তানকে সময় দেবেন না, তাদের বন্ধু হবেন না এবং ভাববেন তারা ভাল থাকবে সেটি ইন্টারনেট ছাড়াও হয়না। আমাদের পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি যদি সঠিক দায়িত্ব পালন করে তবে কারও সন্তান নষ্ট হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। পরিবারের পরের প্রতিষ্ঠান হলো ‘শিক্ষা’ প্রতিষ্ঠান। পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তবে সন্তান নষ্ট হতে পারে না। এছাড়া সামাজিক সচেতনতাও বড় একটি বিষয়। অনেক পরিবার রয়েছে যেখানে বাবা-মা ছেলেমেয়েদের কোন খোঁজখবরই রাখেন না। এমন ক’টা বাবা-মা রয়েছেন যারা সন্তানের প্রতি তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেন? তারা তাদের দায়িত্বটুকু পালন করেন না বলেই অনেক ছেলেমেয়ে মানসিক সমস্যায় ভোগে। ব্লু হোয়েলের মতো গেম সেই মানসিক সমস্যাকে আরও উস্কে দেয়। এভাবেই ধীরে ধীরে সে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়। রাজধানীতে যে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে তার বেলায়ও মানসিক সমস্যার কথাই শুনেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, যারা আত্মহত্যা করে তারা আগে থেকেই মানসিক সমস্যায় থাকে। তা না হলে অনেকেই এই গেম খেলে, কিন্তু সবাই আত্মহত্যা করে না। অনেকেরই ফিরে আসার খবর পাই। তবে ইন্টারনেটসহ সকল প্রযুক্তি ও সামাজিক বিপদ থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার দায়িত্বটা রাষ্ট্রের তথা সরকারেরও। সরকার যেমনি আইন করে, আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সামরিক বাহিনী এবং আদালত দিয়ে নাগরিকদের শারীরিক বিপদ থেকে রক্ষা করে নিরাপত্তা প্রদান করে তেমনি ইন্টারনেটের মতো প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ থেকেও রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হবে। ইন্টারনেটের কথাই বলি। আমাদের দেশে ইন্টারনেট পরিচালনায় ন্যাশনাল ‘গেট ওয়ে’ আছে। এর মধ্য দিয়ে ইন্টানেটের তথ্য-উপাত্ত আসা যাওয়া করে। সেখানে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কোন জিনিসটা দেশে দেখা যাবে আর কোনটা পাওয়া যাবে না। আমরা একে বলি ফিল্টারিং। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সরকার এখনও ফিল্টারিং করার প্রযুক্তি সংগ্রহ করেনি। কয়েক বছর আগে টেন্ডার করে এই প্রযুক্তি সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি সংগ্রহ করার শেষ স্তরে গিয়ে ওটা করা হয়নি। এই প্রযুক্তি সংগ্রহ না করার ফলে আমরা পর্নোগ্রাফি থেকে জঙ্গীবাদ পর্যন্ত বহু বিষয় আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ করা যায়। তবে ব্লু হোয়েল যে ধরনের গেম বা যে অন্ধকার জগতের কীট তা স্বাভাবিক ফিল্টারিং এ গেটওয়েতে ধরা পড়ে না। এটি প্রতিরোধ করতে হবে অন্যভাবে। ‘ডট ওনিয়ন’ নামের সাইটগুলোর জন্য একটা ‘টর’ (টিওআর) ব্রাউজার রয়েছে। এটি ১৯৯০ সালে আমেরিকার সেনাবাহিনী তৈরি করেছিল নিজেদের ব্যবহারের জন্য। সেটি এখন ওপেন সোর্স। এটি এতো ভয়ঙ্কর যে কোন সাধারণ প্রযুক্তি এটার কোন পদচিহ্ন খুঁজে পায় না। এটি ইন্টারনেটের অন্ধকার জগতের মূল ক্ষেত্র। এ ধরনের বিষয়গুলো খুঁজে বের করে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তেমন প্রযুক্তি পেলেই এ ব্লু হোয়েলের মতো বিষয়গুলো প্রতিরোধ করা যেতে পারে। আমি জেনেছি যে, তাদের কাছে ডার্ক ওয়েব এর প্রতিরোধক নেই। আমার জানা মতে, সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব আছে। তাদেরকে এসব বিষয় প্রতিরোধ করার সক্ষমতা দিতে হবে। অন্যদিকে আবারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই আইনগত বিষয়গুলোর দিকে। দেশে গত ৮ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ আন্দোলন চলছে- কিন্তু এখনও আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পেশ করতে পারিনি। এটি চূড়ান্ত হয়ে আছে। কিন্তু শেষ সভাটি বার বার পিছিয়ে এটি মন্ত্রী সভায় যায়নি। কবে যে সেই পথ খোলা হবে তা আমি জানি না। ঢাকা ॥ ৯ অক্টোবর, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক [email protected],
×