ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হকের আজ প্রথম প্রয়াণবার্ষিকী

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হকের আজ প্রথম প্রয়াণবার্ষিকী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি/চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে ...। আজকের এই দিনে থেমে গিয়েছিল সবুজ-শ্যামল স্বদেশের উদ্দীপ্ত অস্তিত্বের কথা বলা কবি সৈয়দ শামসুল হকের পথচলা। সব্যসাচী এই লেখকের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকী আজ বুধবার। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলা ভাষার অনন্য এই কবি ও কথাশিল্পী পাড়ি জমিয়েছিলেন অনন্ত যাত্রায়। শরীরীভাবে বিদায় নিলেও আপন সৃষ্টির আলোয় সাহিত্যের সৃজনভূমিতে তিনি তুমুলভাবে বিরাজমান। যেমনটা তিনি লিখেছিলেনÑ ‘ফুলের গন্ধের মতো থেকে যাব তোমার রুমালে/ধূপের গন্ধের মতো তোমাদের শান্ত সন্ধ্যাকালে...’। সেই প্রত্যাশারই প্রতিফলনে অনুরাগীদের মনে আজো সজীব-সতেজ এই কবি। বিদায়ী-পথের মাঝেও আবির্ভূত হয় তার সৃষ্টিশীলতার পদচিহ্ন। গোটা ছয়টি দশক ধরে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান, নাটক, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যসহ সাহিত্য ও শিল্পের ভুবনে অবিরাম বিচরণ করেছেন বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল বিচরণের সক্ষমতাই সৈয়দ হককে দিয়েছে সব্যসাচী উপাধি। তার সেই সৃজনশীল পথচলা থেমে যায় গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে গভীর শোকাচ্ছন্নতা ছড়িয়ে স্তব্ধ করে দিয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ছুটে যান লন্ডনের রয়েল মার্সেডন হাসপাতালে। সেখানে পাঁচ মাস চিকিৎসার পরও চিকিৎসকরা শোনাতে পারেননি আশার বাণী। এর পরই তিনি ফিরে আসেন নিজ দেশে, মাতৃভূমিতে। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে ভর্তি হন ইউনাইটেড হাসপাতালে। ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবির ইচ্ছামাফিক তার জন্মভূমি কুড়িগ্রামের সরকারী কলেজের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণকারী সৈয়দ হক পেয়েছিলেন ৮১ বছরের বর্ণময় এক জীবন। চরম অসুস্থ থাকাকালীন অবস্থাতেও থেমে থাকেনি সৈয়দ শামসুল হকের কলম। লিখেছেন অবিরাম। যখন নিজে লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেন, তখন স্ত্রী কথাসাহিত্যিক ডাঃ আনোয়ারা সৈয়দ হক করেছেন অনুলিখন। চিকিৎসাধীন ছয় মাসে তিনি প্রায় ২০০ কবিতা, উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’র পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ও আটটি ছোটগল্প রচনা করেন। সাহিত্য-শিল্পের নানা শাখা-প্রশাখায় দীপ্যমান সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আর মা গৃহিণী হালিমা খাতুন। বাবার ইচ্ছা ছেলে সৈয়দ শামসুল হককে বানাবেন চিকিৎসক। যার রক্তে-সাহিত্য সৃজনে আবিষ্ট, তাকে কিভাবে আটকে রাখে পরিবার! তাই তো ১৯৫১ সালে ঘর থেকে পালিয়ে চলে যান মুম্বাইয়ে। পরবর্তীতে দেশে ফিরে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হন। একপর্যায়ে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। এরপর থেকেই লেখালেখিকে নিয়েছিলেন জীবনের প্রধান ব্রত হিসেবে। ১৯৫৪ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘তাস’ প্রকাশের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যাঙ্গনে স্থায়ী আসন করে নেন সৈয়দ শামসুল হক। এর পর একে একে প্রকাশিত হয় ‘শীত বিকেল’, ‘রক্তগোলাপ’, ‘আনন্দের মৃত্যু’, ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’, ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’ নানা বিষয়ে গভীর জীবনঘনিষ্ঠ রচনা। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘এক মহিলার ছবি’। ১৯৬১ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ প্রকাশিত হয়। সৈয়দ হকের ভাষা আর আঙ্গিকের উজ্জ্বল নিরীক্ষার পরিচয় উৎকীর্ণ হয়ে আছে ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘অপর পুরুষ’, ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘পরাণের গহীন ভিতর’সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ। তার লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘নীল দংশন’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’। লিখেছেন ৫০টির বেশি উপন্যাস। কাব্যনাট্য রচনায় ঈর্ষণীয় সফলতা পাওয়া সৈয়দ হক ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি নাটকে রেখেছেন মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। ছোটদের জন্য তার রচনাÑ ‘সীমান্তের সিংহাসন’, ‘আবু বড় হয়’, ‘হাডসনের বন্ধু’ ইত্যাদি। ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’সহ বিশ্বসাহিত্যের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনাও বাংলায় অনুবাদ করেছেন তিনি। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে অনেক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্য গানও লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’র মতো বহু গান মানুষের মুখে মুখে। তাঁর নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস অবলম্বনে গেরিলা নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ৩১ বছর বয়সে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন সব্যসাচী এই লেখক। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। আজ বুধবার বিকেল পাঁচটায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। কবির প্রয়াণবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে কাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ‘মোহরঝরা সোনার কলমওয়ালা একজন’ শীর্ষক তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর। তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের সাক্ষাতকারের পাশাপাশি তার সাহিত্যকর্ম ও ব্যক্তিজীবন। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে এ প্রদর্শনী হবে। তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর পর মঞ্চস্থ হবে সৈয়দ হক রচিত প্রাঙ্গণেমোর পরিবেশিত কাব্যনাটক ঈর্ষা। কুড়িগ্রাম ॥ স্টাফ রিপোর্টার, জানান, গুণী এ লেখক তার সাহিত্য কর্মের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকবেন মানুষের মাঝে। এখন অপেক্ষা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় তার স্মৃতি ধরে রাখা। কলেজ চত্বরে কবির সমাধিকে ঘিরে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করে তার সকল সাহিত্য কর্ম সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছেন কুড়িগ্রামবাসী। সংস্কৃতি কর্মী প্রতিমা চৌধুরী সব্যসাচী এ লেখককে তার জন্ম শহর কুড়িগ্রামের কলেজ মাঠে সমাহিত করায় কুড়িগ্রামবাসী গর্ব বোধ করেন। কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ, মির্জা নাসির উদ্দিন বলেন, কবির সমাধিকে ঘিরে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মিত হলে বহুমাত্রিক এ লেখককের সাহিত্য চিন্তা সমৃদ্ধ করবে কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজের শিক্ষার্থীসহ দেশের সকল সাহিত্য অনুরাগীদের। জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ রাশেদুজ্জামান বাবু জানান, কুড়িগ্রাম তথা দেশের কৃতি সন্তান দেশবরেণ্য সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হকের ১ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে কবির সমাধিস্থলে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, শোক র‌্যালি, আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় তার ১ম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছে। কুড়িগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন জানান, মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এ মানুষটি বিভিন্ন মাধ্যমে অনর্গল লিখে গেছেন। তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুল দিনের সারা জীবনসহ অনেক অমর সাহিত্যের স্রষ্টা তিনি। জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, সব্যসাচী লেখকের ১ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মিলাদ মাহফিল, শোক র‌্যালি এবং তার আত্মজীবনী নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের নক্সা প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পথে, এটি হয়ে গেলেই দ্রুত তা বাস্তায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
×