ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিপিডির সামাজিক সংলাপে বক্তারা

শ্রমমান উন্নয়নে পোশাকের দাম বাড়ানোর তাগিদ

প্রকাশিত: ০২:০৭, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

শ্রমমান উন্নয়নে পোশাকের দাম বাড়ানোর তাগিদ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ রানা প্লাজা ধসের চার বছরে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে পোশাকের বিদেশী ক্রেতারা বড় কোন পদক্ষেপ নেয়নি। নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি এবং শ্রম অধিকার রক্ষায় তাদের প্রতিশ্রুত অর্থও পাওয়া যায়নি। এর চেয়ে বড় সমস্যা তৈরি পোশাকের দাম নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে ৫ ডলারে কিনে নিয়ে ওই পোশাক বিক্রি হচ্ছে ২৫ ডলারে। অথচ ন্যায্য দামের অভাবে দেশের গার্মেন্টস কারখানা প্রতিযোগীতায় টিকতে পারছে না। রবিবার রাজধানীর গুলশানের গার্ডেনিয়া গ্রান্ড হলে আয়োজিত সামাজিক সংলাপে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। রানা প্লাজা ধসের চার বছর উপলক্ষ্যে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বিশ্ব পণ্য সরবরাহব্যবস্থায় একধরনের অন্যায্যতা আছে। বাংলাদেশ থেকে একটি তৈরি পোশাক পাঁচ ডলারে কেনা হয়। তারপর তা বিশ্ববাজারে ২৫ ডলার কিংবা এর বেশি দামে বিক্রি হয়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তাহলে পণ্য সরবরাহব্যবস্থায় ওই ২০ ডলার কোথায় যায়? এই অন্যায্য ব্যবস্থার কারণে সবাই এর সুফল পাচ্ছে না। আমরা ৫ ডলার নিয়ে আলোচনা করছি কিন্তু বাকি ২০ ডলার কোথায় যায় তা নিয়ে কোন পক্ষের কোন মাথা ব্যথা নেই। এটি একটি কাঠামোগত সমস্যা। তিনি আরও বলেন, রানা প্লাজা ইস্যুতে জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি সংসদীয় কমিটিতেও কোনো আলোচনায় হয়নি। রাজনৈতিকভাবে যে নজরদারির প্রয়োজন, এক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। আমরা যতই আলোচনা করি না কেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি আরও বলেন, রানা প্লাজার মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরও শ্রমিকদের উন্নয়নে বড় ধরনের কোনো কর্মসূচী নেয়া হয়নি। কারখানা কমপ্লায়েন্স করতে হলে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। ক্রেতারা গার্মেন্টসখাত সংস্কারে অর্থের যোগান দিতে পারতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো তারা তেনম কিছুই করেনি। রেহমান সোবহান বলেন, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক ও সমন্বয় থাকলে রানা প্লাজার মতো এমন বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। ওই দুর্ঘটনার পর সামাজিক জবাবদিহিতার চরম অভাবের বিষয়টিও ফুটে উঠেছে। জনপ্রতিনিধিরাও এ ঘটনার পর্যালোচনা করেননি। গত ৪ বছরে সংস্কারে প্রচুর ঘাটতি ছিল। শুধু নীতিকথা বললেই হবে না, সংস্কার করতে হবে। ক্রেতা, উদ্যোক্তা ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের সমতা দরকার। সরকারের সুশাসনে এখনও দুর্বলতা রয়েছে। সংলাপে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশনের ডেপুটি হেড ইয়োগান হেইম্যান বলেন, আগামী ১৮ মে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এবং এর কর্মপরিবেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আলোচনা হবে। সেই বৈঠকের ফল যদি নেতিবাচক হয়, তবে ইউরোপের বাজারে যে অগ্রাধিকার সুবিধা বাংলাদেশ পায়, তাতে সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতে পারে। জিএসপি ইস্যুতে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। তার এই বক্তব্যের পর সংলাপে অংশ নিয়ে শ্রম সচিব মিকাইল সিপার বলেন, রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর সরকার যথেষ্ট সচেতন হয়েছে। ভবিষ্যতে শ্রমিকদের উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে সচেষ্ট সরকার। ইতোমধ্যে শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড গঠন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা সরকার থেকেও আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছেন। এছাড়া গার্মেন্টখাত উন্নয়ন এবং সমস্যা নিরসনে মালিক, শ্রমিক এবং সরকারের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি কাজ করছে। সংস্থাটির সম্মানীত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রানা প্লাজা ধসের পরে বেশকিছু উদ্যোক্তা ব্যবসা ছেড়েছেন। এই ঘটনার পর ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে যে পরিমাণ অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল-তা হয়নি। দেশে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু কার্যকারিতা কম। তিনি অভিযোগ করেন, রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তরা পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি, তাদের পুনর্বাসনও হয়নি। বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, গার্মেন্টসের মোট শ্রমিক সংখ্যা কত-তা আমরা এখনও জানি না। গত ৮ মাস ধরে বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ তৈরির কাজ করছি। এখন পর্যন্ত ১১ লাখ শ্রমিক এর আওতায় এসেছে। শ্রমিক নেতাদের ট্রেড ইউনিয়নের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, গার্মেন্টস খাতে এখন পর্যন্ত ৫৯১টি ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। অথচ এসব কারখানার মধ্যে মাত্র ২৬০টি কারখানা চালু রয়েছে। তিনি বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো আমরা আইন মানছি কি না? পোশাকের দামের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, বিদেশে ক্রেতারা তাদের ব্যবসা দেখবে, দাম বাড়ানোর চাপ দিলে তারা ইথিওপিয়া বা পার্শবর্তী দেশ ভারতে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। গার্মেন্টস খাতকে এগিয়ে নিতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে ভারত-বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এমনকি ভিয়েতনামও নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পরিচালক শামসুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। গার্মেন্টস পরিদর্শন বাড়িয়ে দিয়েছি। শ্রমিকদের ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। শ্রমিক নেতা কামরুল ইসলাম বলেন, রানা প্লাাজা দুর্ঘটনায় বিদেশি সংস্থা থেকে ক্ষতিপূরণের একটি প্যাকেজ পেয়েছি। আইনানুগ কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। স্পেকটার্ম গার্মেন্টস দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হলেও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত ৪ বছরে শ্রমিকদের কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়নি। সংলাপে অংশ নিয়ে শ্রমিক নেত্রী নাজমা বেগম বলেন, সব প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ভরে গেছে। কিন্তু আমাদের হতাশ হলে চলবে না। সামনে জিএসপি ইস্যু কীভাবে রিকভারি করবো-সেটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তিনি বলেন, শ্রম অধিকার রক্ষা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে মালিকপক্ষকে আরও আন্তরিক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। শ্রমিক নেতা তৌহিদুর রহমান বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় অনেক শ্রমিক এখনও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তারা কাজে যোগ দিতে ভয় পান, এমনকি বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করতেও ভয় পান। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে সাড়ে ১৪ শতাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছেন। আর ৪২ শতাংশ শ্রমিক এখনও বেকার রয়েছেন। তাদের ফেরানোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। সংলাপে অংশ নিয়ে শ্রমিক নেতা বাবুল আক্তার বলেন, যারা মরে গেছে তারা বেঁচে গেছে। যারা বেছে আছে তাদের নিয়ে শুধু আলাপ-আলোচনা হয়, আর কিছুই না। যতটুকু হয়েছে বিদেশিদের চাপেই হয়েছে। সরকার মন থেকে কিছু করেনি। উল্টো সামাজিক সংলাপের নামে শ্রমিকদের ডেকে নিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলার বিচার এখনও শুরু হয়নি। ক্ষতিপূরণের কোনো মানদন্ডও নেই।
×