ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

নেত্রকোনার দুর্গাপুরে সাত দিনব্যাপী কমরেড মনি মেলা শুরু

প্রকাশিত: ২১:৫৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫

নেত্রকোনার দুর্গাপুরে সাত দিনব্যাপী কমরেড মনি মেলা শুরু

নিজস্ব সংবাদদাতা,দুর্গাপুর(নেত্রকোনা) ॥ টংক আন্দোলনের মহান নেতা , মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কমরেড মনি সিংহের ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার ৩১ ডিসেম্বর-২০১৫ থেকে ৬ জানুয়ারী-২০১৬ বুধবার পর্যন্ত সাতদিন ব্যাপী নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরে টঙ্ক স্মৃতি স্তম্ভ প্রাঙ্গনে ঐতিহাসিক কমরেড মনিসিংহ মেলা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি পুরুষ মনি সিংহ ১৯০১ সালে ২৮ জুলাই কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। মাত্র আড়াই বছর বয়সে পিতা কালী কুমার সিংহের মৃত্যু হলে সহায়সম্বলহীন হয়ে ঢাকায় তার মামা ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সুরেন সিংহের বাড়ীতে থাকেন। মনি সিংহের মা সরলা দেবী ছিলেন তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার সুসঙ্গ দুর্গাপুরের জমিদারদের বড় বোন। মনি সিংহের সাত বছর বয়সের সময় তার বিধবা মাতা সে সূত্রে জমিদারদের কাছ থেকে বসত ভিটা সহ কিছু ভু সম্পত্তি,সাংবাৎসরিক খোরাকী ও সরিক হিসেবে মাসোহারা পেয়ে সুসঙ্গ দুর্গাপুরে বাস করতে থাকেন। এখানে স্কুল শিক্ষা লাভের সময় তিনি ”অনুশীলন” দলের সাথে পরিচিত হন । ”অনুশীলন” দল সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতিতে বৃটিশরাজ উচ্ছেদ সম্বব বলে মনে করতো। তিনি ১৯১৪ সালে এই দলে যোগ দিয়ে ক্রমশ তৎকালীন বাংলার বিপ্লবী কর্মকান্ডে নিজের স্থান করে নেন। দুই শত বছরের বৈদেশিক শাসনের জিঞ্জির থেকে উপমহাদেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে অসহযোগ খেলাফত আন্দোলনে যেসব সদস্য যোগ দেন যারাসর্বস্ব ত্যাগ করে সামনের সারিতে যোগ দিয়েছিলেন কমরেড মণিসিংহ তাদের অন্যতম।১৯২১ সালে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের বিপুল গনজাগরন তরুন মণি সিংহের মনে গভীর রেখাপাত করে এবং সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতি সম্পর্কে তার মনে সংশয় দেখা দেয়। বৃটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামে কৃষকদের টেনে আনার উদ্দেশ্যে তিনি নিজ জেলার কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। ১৯২৫ সালে রুশ বিপ্লবের আদর্শে উদ্ভুদ্ধ প্রখ্যাত বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে সুসঙ্গে আলোচনার পর মণিসিংহ মার্কসবাদ ও লেনিন বাদকে আদর্শরুপে গ্রহন করে এবং কলকাতায় গিয়ে ”অনুশীলন” দলের সাথে চুরান্তভাবে সম্পর্ক ছেদ করে আসেন।১৯২৮ সালের মেটিয়াবুরুজে শ্রমিক রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে কেশোরাম কটন মিলে শ্রমিকদের ১৩ দিন ব্যাপী ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি দাবী আদায় করতে সক্ষম হন। ২ বছর পর ৯ মে তিনি কলিকাতায় গ্রেফতার হন।পাঁচ বছর পর জেল থেকে মুক্ত হলে নিজ গ্রাম সুসঙ্গে তাকে অন্তরীণ রাখা হয়।এ সময়ে সুসঙ্গে টংক প্রথার অত্যাচারে নিপিড়িত কয়েক জন কৃষক তাঁর সংগে যোগাযোগ করেন।টংক মানে ধান কড়ারী খাজনা।হোক বা না হোক ধান দিতে হবে টংক জমির উপর কৃষকদের কোন সত্ব ছিল না। ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে সুসঙ্গ দুর্গাপুর,কলমাকান্দা,হালুয়াঘাট ,নালিতাবাড়ী ও শ্রীবর্দি থানায় এই প্রথা প্রচলিত ছিল সৃসঙ্গ জমিদারি এলাকায় এর প্রচলন ছিল ব্যাপক। এর ন্থানীয় নাম ছিল টংক। একমাত্র সুসঙ্গ জমিদাররাই এই প্রথায় দুই লক্ষ মন ধান আদায় করতেন। এটা ছিল জঘন্যতম সামন্ততান্দ্রিক শোষন। সেই সময়ে জমিদারের অধিনস্থ এক মজুরের পক্ষাবলম্বন করায় আপন মাতুল বংশের জমিদারদের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়।সেই সময়ে পাট চাষীদের পক্ষে ন্যায্যমূল্য দাবী করে বক্তব্য দেওয়ায় তার দের বছরের কারাদন্ড হয়। কারাা মুক্ত হয়ে ১৯৩৭ সালে তিনি মাকে দেখার জন্য সুসঙ্গে আসেন। মনি সিংহের নিজ এলাকার দশাল গ্রামের মুসলমান কৃষকেরা টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মনিসিংহের সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি আপন মাতুলদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘাতে লিপ্ত হন। এ থেকেই তিনি টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পরেন। ১৯৪৪ সালে মনি সিংহ সারা বাংলার কৃষান সভার প্রেসিডিয়ামের সভ্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষান সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ছিলেন সম্মেলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পরে পূর্ণ গনতন্ত্র ও শোষন মুক্ত সমাজের আদর্শকে যারা সামনে এনেছেন মনি সিংহ তাদের একজন।১৯৬১ সালে নভেস্বর মাসে পাকিস্তানের মার্শাল’র বিরুদ্ধে গন আন্দোলন গড়ে তোলার দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে আওয়ামীলীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় । এই বৈঠকে বিখ্যাত সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী এবং আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান( তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হননি),ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, এবং কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কমরেড মনি সিংহ ও খোকা রায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে মনি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারী কমরেড মনিসিংহ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে তিনি পার্টির দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯০ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর মৃত্যুবরন করেন। সাতদিন ব্যাপী মেলায় জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ,দেশবরেন্য বুদ্ধিজীবি,ও সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিগন উপস্থিত থাকবেন।
×