ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

খাগড়াগড় বিস্ফোরণ অর্থায়নেও সোনা ব্যবহারের তথ্য ইতোমধ্যেই ফাঁস ;###;দুই বাংলায় রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট;###;গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলেও মাদক, অস্ত্রসহ পণ্যের বিনিময়ে সোনা ব্যবহার

শাহজালাল নিরাপদ পাচার রুট ॥ জঙ্গী অর্থায়নে সোনা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩ মার্চ ২০১৫

শাহজালাল নিরাপদ পাচার রুট ॥ জঙ্গী অর্থায়নে সোনা

আজাদ সুলায়মান ॥ হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। তারা পালা করে তিন শিফটেই ডিউটি করে। সঙ্গে রয়েছে এপিবিএন, থানা পুলিশ, র‌্যাব ও সিভিল এ্যাভিয়েশনের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী। তারা নিñিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলার পরও সোনা আসছে দেদার। প্রতিদিন না হলেও প্রতি সপ্তাহে তো ধরা পড়ছেই ছোট-বড় চালান। এই সোনা বাস ও ট্রেনে সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা, বেনাপোল, কুষ্টিয়া, যশোর ও রাজশাহী দিয়ে পাচার করা হয় ভারতে। ওখানকার খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ কা-েও জঙ্গীদের অর্থায়নে সোনা ব্যবহারের তথ্য ফাঁস হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি জঙ্গীগোষ্ঠীর মাধ্যমে এ সোনা ভারতে পাঠানো হয়। বিজিবি জানিয়েছে-দুই বাংলাতেই সোনার চালান নিয়ে সক্রিয় শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সূত্র জানায়, গত চার দশকে জব্দকৃত ২ টন সোনাই এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপদ ভল্টে গচ্ছিত। এ সোনার সবটুকুই যোগ হয়েছে বর্তমান রিজার্ভ ফান্ডের ২২ বিলিয়ন ডলারের সঙ্গে। এ যাবত বিমানবন্দরে আটক করা সোনার কোন মামলার বিচার সম্পন্ন হওয়ার নজির দিতে পারেনি আদালত ও পুলিশ। শুধু গত পাঁচ বছরেই মামলা দায়ের করা হয়েছে ২১২টি। এর অধিকাংশই চার্জশীট হলেও আদালতে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি একটিও। যারা ধরা পড়েছেন তাদের বেশিরভাগই জামিনে এসে ফের লিপ্ত হয়েছেন। সোনা চোরাচালানের এমন চিত্রে প্রশ্ন খোদ শুল্ক বিভাগেরÑ তাহলে চোরচালান বন্ধ হবে কিভাবে? গোয়েন্দারা জানিয়েছে, সোনা চোরাচালান এখন নতুন মোড় নিয়েছে। দেশ-বিদেশে ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গী সন্ত্রাসীদের অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে চোরাচালানের এ সোনা। মুদ্রার চেয়ে সোনা পাচার বেশি নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও সহজসাধ্য হওয়ায় জঙ্গী অর্থায়নে সোনার চাহিদা বেশি। প্রশ্ন ওঠছে, এত গোয়েন্দা সংস্থা যেখানে সক্রিয়, সেখানে শাহজালালকেই কেন দেশী-বিদেশী স্মাগলাররা নিরাপদ বিমানবন্দর মনে করছে? এ বিষয়ে শাহজালালে কর্মরত একটি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান বলেন, এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাপক ত্রুটি রয়েছে। শাহজালালের টার্মিনাল ভবনের গেট ছাড়াও বাইরে বের হওয়ার জন্য গেট রয়েছে কমপক্ষে সাতটি। ওখানে নিরাপত্তাকর্মী থাকলেও তারা কর্মকর্তাদের গাড়ি চেক করতে পারে না। গাড়ি চেক করার জন্য নেই ভেহিক্যাল স্ক্যানার। ফলে ম্যানুয়াল চেক করার সুযোগও নেই। মূলত নিরাপত্তার আড়ালে রয়েছে বজ্রআঁটুনি ফস্কা গেরো। এ জন্য সব গেট দিয়েই সোনা বের করার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। সোনা পাচারের জন্য শাহজালাল এখন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ বিমানবন্দর। দেশী-বিদেশী গডফাদাররা এ জন্যই এটাকে সোনাপাচারের জন্য বেছে নিচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দার হিসাব মতে, গত দেড় বছরেই ধরা পড়েছে প্রায় ১ হাজার কেজি অর্থাৎ এক টন সোনা। এ সোনার সবটাই রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। কিন্তু পাচার হচ্ছে কী পরিমাণ? বিমানবন্দর ও সীমান্তে কর্মরত একাধিক গোয়েন্দা তথ্যমতে, গত দেড় বছরে কমপক্ষে ২৫ টন সোনা পাচার হয়েছে। এর সবই এসেছে শাহজালাল ও শাহআমানত বিমানবন্দর দিয়ে। বার বার ধরা পড়ার পরও কেন থামছে না এ চোরাচালান? এ সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহজালাল আর্মড পুলিশের অধিনায়ক রাশেদুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, সোনা যা ধরা পড়ছে তাতে চোরচালানিদের লোকসান হয় না। চোরাইপথে আনা সোনার যদি ৪০ শতাংশও ধরা পড়ে তাহলেও তাদের লাভ থাকে। এ কারণেই সোনার চালান ঠেকানো যাচ্ছে না। চোরাচালানের এমন ভয়াবহতায় এখন রীতিমতো উদ্বিগ্ন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। নতুন চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বিমানবন্দরকেন্দ্রিক চোরচালান ঠেকাতে নিয়েছেন অলআউট এ্যাকশান প্ল্যান। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে রাজস্ব বোর্ডে তলব করা হয় বিমানের নতুন বিদেশী এমডি হেয়্যুদ কেইলকে। তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়েছে কেন বার বার বিমানের ফ্লাইটে বড় বড় চালান আনা হচ্ছে। বাংলাদেশের চোরাচালানের সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন ধরনের ধারণা না থাকায় তিনি কোন ধরনের মন্তব্যও করতে পারেননি। শুধু আশ্বাস দিয়েছেনÑ চোরাচালান রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। জনকণ্ঠকেও কেইল বলেছেন, সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হবে। কোন ঘটনাই অবহেলা করা হবে না। কয়েকটির কাজ চলছে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, এখন এ সোনা শুধু ভারতেই পাচার হচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বাংলাদেশের বিভিন্ন রুটে চোরাচালানের অন্যান্য পণ্যের বিনিময় হিসেবেও সোনা ব্যবহার হয়। যেমন ভারত থেকে যখন গরু ও ফেনসিডিল আসে সেটার মূল্য পরিশোধ করা হয় সোনা দিয়ে। এভাবে মাদক, অস্ত্র ও জঙ্গী অর্থায়নেও ব্যবহৃত হচ্ছে সোনা। এ কারণে সোনার দাম বাড়লেও এর চোরাচালান থামবে না। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ জানায়, যতদিন মাদক, মুদ্রা পাচার সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ থাকবে ততদিনই সোনার ব্যবহার চলবে। গত দেড় বছরে চোরাই সোনা আটক করা হয়েছে এক হাজার কেজি। টাকার অংকে এটা তেমন বেশি মনে না হলেও এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সোনা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। জাতি হিসেবে এটা খুবই লজ্জার। আর অর্থনীতিতে কি ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, সেটার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টি হুমকির মুখে। কারণ সোনা যেভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা হচ্ছে সেভাবে বড় ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য ও মারণাস্ত্র বিমানে করে আনা সম্ভব। কাজেই এ ধরনের বেপরোয়া চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করাই এখন রাষ্ট্রের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে এ ধরনের তথ্য। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বৈধভাবে শুল্ক পরিশোধ করে সোনা আমদানিতে তেমন লাভ থাকে না। তাতে ব্যবসায়ীরা বৈধ আমদানিতে আগ্রহ হারিয়ে বেছে নিচ্ছে ব্যাগেজ রুল, যার অর্থ হচ্ছে প্রতিদিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের মাধ্যমে ব্যাগেজ রুলে সোনা আনা হচ্ছে। পরে তাদের কাছ থেকে সোনা ব্যবসায়ীরা সে সোনা কিনে নেয়। গত দু’বছর ধরে এভাবেই চলছে দেশীয় সোনার মাকের্ট। ঢাকা কাস্টমস হাউস জানিয়েছে, গত এক বছরে একরতি সোনাও আমদানি হয়নি। তাতেই প্রমাণ হয় দেশের শীর্ষ সোনা ব্যবসায়ীরা বিকল্প পথে সোনা আনছে। সোনা ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশে প্রতিবছর সোনার চাহিদা কমপক্ষে পাঁচ টন। সোনার এ বিশাল চাহিদা মেটানোর জন্য গত এক বছরে বৈধ পথে একরতি সোনাও আমদানি করা হয়নি। তাহলে এ সোনা আসে কোথা হতে? শুল্ক বিভাগ তথ্যপ্রমাণাদি দিয়ে বেশ জোরেই বলছে, চাহিদার কিছু অংশ বৈধ পথে ব্যাগেজ রুলে আনা হচ্ছে। সেটার পরিমাণ কিছুতেই বছরে ৫০ মনের বেশি হবে না। এ হিসাবে বাকি সব সোনার একমাত্র উৎস চোরাচালান। তবে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি দিলীপ বলেছেন, মোট চাহিদার পঁচাত্তর শতাংশই দেশীয় উৎসের সোনা, যা প্রতিবছর হাতবদল হচ্ছে। বাকি সোনা আসছে ব্যাগেজ রুলে। এ বিষয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক সোনা ব্যবসায়ী বলেছেন, শুধু সোনানীতি না থাকায় আজ এত সঙ্কট। এত ঝামেলা হচ্ছে। যেমন ভারতে ব্যবসায়ীরা সোনা সংগ্রহ করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। ব্যবসায়ীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সোনার চাহিদা অনুযায়ী টাকা জমা দেয়। তারপর ব্যাংক আমদানি করে সেটা রিসিট রেখে ব্যাবসায়ীদের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু ঢাকায় শীর্ষ সোনা ব্যাবসায়ীদের জন্য এ ধরনের কোন সুযোগ নেই। তাদের সোনা সংগ্রহ করতে হয় প্রচলিত পদ্ধতিতে। তাঁতীবাজারের কিছু সোনা ব্যবসায়ী আছে, তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এখন তাঁতীবাজারের ব্যবসায়ীরা কোথা থেকে এ সোনা আনছে সেটা আামাদের জানা নেই। কিছু সোনা তারা দেশীয় মার্কেট থেকে হাতবদল পদ্ধতিতে আনছে। এটাকে বলা হয় বুলিয়ান পদ্ধতি। কিছু সোনা আসছে বৈধভাবেই। ব্যাগেজ রুলে যাত্রীরা তো একটা পরিমাণ সোনা আনতেই পারে। হজের সময় এটা বাড়ে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কারণেই বাংলাদেশ এখন সোনা চোরাচালানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ট্রানজিটে পরিণত হয়েছে। চোরাচালান ছাড়াও গত এক বছরে বাজারে যে সোনা বেচাকেনা হয়েছে, তা থেকে আদায়কৃত ভ্যাট ও রাজস্বের পরিমাণ আরও হতাশাব্যঞ্জক। জুয়েলার্স সমিতির দেয়া হিসেবের সঙ্গে ভ্যাট আদায়ের বিপরীতে বিক্রি করা সোনার পরিমাণেও দেখা যায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। চোরাচালানিরাই জানিয়েছে, বিমানবন্দরে যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়েছে; তা চোরাচালানের দশ ভাগের এক ভাগ। ২০১৩ সালের জুনে ধরা পড়া এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ ১২৪ কেজি চালানের চেয়েও আরও অনেক বড় চালান বিমানবন্দরের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে গেছে মে মাসে। ওই চালানে সাড়ে পাঁচ মণ সোনা আনা হয়। বাংলাদেশ বিমানের একটি এয়ারবাসের কার্গো হোলের ভেতরে লুকিয়ে আনা হয় ওই চালান। তা খালাস করা হয় বিমানের প্রকৌশল হ্যাঙ্গারে। দুবাই থেকে আনা সে চালান নিয়ে অনায়াসেই বিমানবন্দর পার হয়ে যাওয়ায় চোরাচালানিরা উৎসাহিত হয়ে পরের চালান আনে এবং ঘটনাক্রমে সেটা ধরা পড়ে যায়। কোথায় যায়? শাহজালাল বিমানবন্দরে গত এপ্রিলের পর থেকে ধরা পড়া বড় বড় চালানগুলোর গন্তব্য ছিল ভারত। ধরা পড়া বেশ ক’জন ক্যারিয়ার জনকণ্ঠকে জানিয়েছে, শাহজালাল থেকে বের করে সে সোনা সড়ক পথে শার্শা, যশোর, সাতক্ষীরা ও রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে পাঠানো হয় ভারতে। এ বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা যায়, এতদিন বলা হচ্ছিল সব সোনার গন্তব্য ভারত। এখন গোয়েন্দারা বলছে, শুধু ভারত নয়। দেশের অভ্যন্তরেও আন্তজার্তিক মাফিয়াচক্র সোনাকে তাদের বিনিময়মূল্য হিসেবে ব্যবহার করছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে কর্মরত একটি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান জনকণ্ঠকে জানান, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে ধৃত জঙ্গীদেরও অর্থায়ন করা হতো ঢাকা থেকে পাচারকৃত চোরাই সোনায়। এ জাতীয় অপরাধে মুদ্রার চেয়ে সোনার বিনিময় বেশি নিরাপদ ও সহজ। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান বলেন, শুধু কারখানায় অলঙ্কার তৈরি ও মানুষের ব্যবহারের জন্য চোরাচালান হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা ও জঙ্গী অর্থায়নের জন্যও সোনা ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন এক কোটি টাকা এক দেশ থেকে অন্য দেশে বহন করা যতটা কঠিন, সমপরিমাণ সোনা বহন ততটা সহজ। বাংলাদেশে আসা অর্ধেক সোনাই ব্যবহার হচ্ছে অন্যান্যা অপরাধ কর্মের বিনিময়মূল্য হিসেবে। চোরাচালানের গরুর মূল্য পরিশোধ করা হয় সোনায়। তিনি মনে করেন, সব সোনার গন্তব্য ভারত নয়। কারণ শুধু অলঙ্কার তৈরির জন্য এত সোনার প্রয়োজন নেই। যদিও ভারতে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম সোনা ও মণিমুক্তা দিয়ে তৈরির অলঙ্কার শিল্প-কারখানা। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে বিশাল অবকাঠামো। জানা যায়, ভারতে সোনার ওপর অস্বাভাবিক করারোপ করায় শিল্প-কারখানাগুলো চরম সঙ্কটে পড়ে। এতে আমদানি প্রবাহ একেবারে কমে যায়। বৈধভাবে আমদানি করে আনা সোনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো বেছে নেয় বাঁকা পথের। শুধু কর ফাঁকি দেয়ার জন্য আমদানিকারকরা আমিরাত থেকে চোরাইপথে সোনা আনার জন্য বেছে নেয় বাংলাদেশকে। ওরা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, দুবাই থেকে অনায়াসে সোনা কিনে তা ঢাকা হয়ে ভারতে নেয়া যথেষ্ট সহজসাধ্য ও নিরাপদ। এ কারণেই শাহজালালে সোনা ধরার চিত্র এতটা ভয়াবহ। এ ছাড়া এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ভারতীয় নাগরিককে সোনাসহ ধরা হয়েছে। তারা এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। জানা যায়, দুবাই থেকে আকাশ পথে বাংলাদেশের বিমানবন্দর হয়ে চালান ভারতে নেয়ার জন্য গড়ে তোলা হয় একটি সিন্ডিকেট। একই সিন্ডিকেটের সহায়তায় দুবাই থেকে প্রায় ২৩টি চালান আনা হয় গতবছর এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত। এ সব সোনার বেশিরভাগই বাস ও ট্রেনে সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে ভারতে পাচার করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বড় চালানের বেশিরভাগই আসছে দুবাই থেকে। সৌদি আরব মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকেও আসছে। দুবাই থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয়। এ সিন্ডিকেটে রয়েছে কলকাতা, দিল্লী ও ম্ম্বুাইয়ের তিনজন শীর্ষ মারোয়ারী ও ঢাকার ৬ জন গডফাদার। এর মধ্যে মাসতিনেক আগে মোহাম্মদ আলী নামের একজন ধরা পড়েছে। তিনি এখন কেন্দ্রীয় কারাগারে। বিমানে সোনা ঢুকে কিভাবে? বারবারই বিমানের উড়োজাহাজের টয়লেটের ভেতরে কালো কাপড়ে সুতো দিয়ে একই কায়দায় সোনার চালান আনা হচ্ছে। মাঝে মাঝে সিটের নিচেও থাকে। অন্যান্য এয়ারলাইন্সেও আনা হয়। সম্প্রতি সিঙ্গাপুর ও ইমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটেও কয়েকটি চালান আনা হয়। খোদ গোয়েন্দাদের প্রশ্ন, টয়লেটের দেয়াল কেটে ভেতরে সোনা লুকানো এবং বের করার সঙ্গে কারা কারা জড়িত। সাধারণ যাত্রীর পক্ষে এমনভাবে কিছুতেই সোনা ঢুকানো বা বেরা করা সম্ভব নয়। এটা টেকনিক্যাল কাজ। উড়োজাহাজ যখন হ্যাঙ্গারে নেয়া হয়- তখনই এ সোনা বের করে নেয়া হয়। এ ব্যাপারে বিমানের একজন পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেছেন, দুবাইয়ের কান্ট্রি ম্যানেজার ও স্টেশন ম্যানেজারের সহযোগিতা ছাড়া কিছুতেই এত বড় চালান উড়োজাহাজে তোলা সম্ভব নয়। দুবাইয়ে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ যে প্রতিষ্ঠানই করুক, কি পরিমাণ পণ্য জাহাজে ওঠবে, তার হিসাব ও দায়ভার সেখানকার কান্ট্রি ম্যানেজার ও স্টেশন ম্যানেজারের। বিমানসূত্র এ সম্পর্কে বলছে, দুবাই থেকে সোনা আনায় কোন বিধিনিষেধ নেই। যে যত ইচ্ছে সোনা কিনে আনতে পারে। বিমানবন্দরে কাস্টমস শুধু যাচাই করে সোনা কেনার ক্যাশ ম্যামো আছে কিনা। এতে চোরাচালানকারীদের বিমানবন্দরে কোন সমস্যা হয় না। আর দুবাই এয়ারপোর্টে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে দুবাই ন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি (ডিএনএটিএ)। ওই কোম্পানির যোগসাজশ ছাড়া কোন ফ্লাইটে সোনা ঢুকানো সম্ভব নয়। বিমানের এ তথ্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান। তিনি জানান, ১২৪ কেজি সোনার চালান দুবাই থেকে আনা হয়। এ মামলা তদন্তে তার নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি সরেজমিনে দুবাই পরিদর্শন করেন। তখন তারা দুবাই কাস্টমসের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারেন-ওইদিন ১২৪ কেজি সোনা ওই ফ্লাইটের কোন যাত্রীর কাছে থাকার কোন ম্যামো ছিল না। তার মানে এ সোনা সেখানকার কাস্টমসকেও ফাঁকি দিয়ে ফ্লাইটে ওঠানো হয়েছে। একই সিন্ডিকেট? ২০১৩ সালের ২৪ জুলাইয়ে বড় চালান ছিল ১২৪ কেজির। গত বছরের ২৬ এপ্রিল ছিল ১০৬ কেজি। শুল্ক গোয়েন্দারা জানায়, দুটো চালানেরই যোগসাজশ রয়েছে। দুটো চালানই খালাস করা হতো হ্যাঙ্গারে। জড়িতও ছিল সেই সিন্ডিকেট। শুল্ক গোয়েন্দাদের একটি উচ্চ কমিটি এসব তদন্ত করতে দুবাইয়ে যায়। তারা সেখানে বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজারসহ বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তদন্ত কমিটির সদস্যের অভিমত- দুবাইয়ে বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজারের অজান্তে এত বড় চালান উড়োজাহাজে তোলা সম্ভব নয়। একইভাবে ঢাকায় বিমানের নিরাপত্তা বিভাগের শীর্ষ কর্তাদেরও সন্দেহের শীর্ষে রেখেছে তদন্ত কমিটি। অবশ্য ১২৪ কেজি সোনার মামলার ১৪ জন আসামির মধ্যে ১০ জনই বিমানের। তাদের ৪ জন এখন জেলে। সূত্র জানায়-বিমান প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তাদের অজান্তে কিছুতেই হ্যাঙ্গাারে সোনা খালাস করা সম্ভব নয়। আর উড়োজাহাজের টয়লেট কেটে সোনা লুকানোর মতো ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূূর্ণ কাজ করাটাও শুধু নিচের লেভেলের মেকানিক বা ক্লিনারের পক্ষে সম্ভব নয়। এতে বিভাগীয় প্রধানের দায় দায়িত্ব নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। নেপথ্য নায়ক কারা? কারা এত বড় বড় চালান আনছে- এটাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শুল্ক মহাপরিচালক মইনুল খান জানান-অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূল হোতা বা ক্যারিয়ার ধরা পড়ছে না। যে কজন ধরা পড়ছে তারাও সোনার মালিক নয়। ওরা পেশাদার ক্যারিয়ার বা বহনকারী। ওরা শুধু স্টেশন টু স্টেশন ক্যারিয়ার। এ ব্যবসা করে তারা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পেয়ে যায়। দুবাই থেকে সোনা কেনার টাকাও পাচার করা হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়-এ পর্যন্ত এক হাজার কেজি সোনা শুধু ধরা পড়লেও বড় গডফাদার ধরা পড়েছে শুধু মোহাম্মদ আলী নামের একজন। মাস তিনেক আগে নগরীর পল্টনে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে চার মণ সোনা ও আট কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার এ সোনার মালিক সিরাজগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন। তিনিই সোনার প্রকৃত গডফাদার। এ ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক। ডিবি বর্তমানে তাকেও আটকের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। ডিবি জানায়, মোহাম্মদ আলীই দেশের শীর্ষ গডফাদার। শাহজালাল দিয়ে আনা সোনার ছোট ছোট চালান তিনি কিনতেন। বিশেষ করে ব্যাগেজ রুলে আনা সোনার বেশিরভাগই তার কাছে বিক্রি করা হতো। পরে তার বাসা থেকে সড়ক পথে বিভিন্ন সময়ে সুযোগমতো সে সোনা পাচার করা হতো ভারতে। তার বাসা থেকে জব্দ চার মণ সোনার গন্তব্য ছিল ভারত। সেগুলো পাঠানোর আগে ধরা পড়ে যায় শুল্ক গোয়েন্দার অভিযানে। একের পর এক উড়োজাহাজ জব্দ ॥ চোরাচালানের মাল হাতেনাতে ধরা পড়ায় এ পর্যন্ত বিমানের তিনটি উড়োজাহাজ জব্দ করা হয়। ১২৪ কেজি সোনা আসে বিমানের এয়ার বাসে। ১০৬ কেজির বিশাল চালানও আসে নতুন বোয়িং অরুণ আলোতে। দুটো উড়োজাহাজের লক্ষ্য ছিল বিমানের হ্যাঙ্গার। সেখানে নেয়ার আগেই চালান দুটো ধরা পড়ে। তারপর সর্বশেষ ধরা পড়ে ৬২ কেজি গত ফেব্রুয়ারি। এ জন্য জব্দ করা হয় রাঙ্গাপ্রভাত উড়োজাহাজ। ডক্টর মইনুল খান জানান, আদালতে যদি প্রমাণ হয় জব্দকৃত উড়োহাজেই সোনা আনা হয়েছে, তাহলে ওই উড়োজাহাজের যে দাম তার চারগুণ জরিমানা আদায় করা হবে। এমনটি হলে বিমানের সামনে তো অনেক বড় সঙ্কট। প্রশ্ন ওঠেছে- বিমান কেন নিরাপদ বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সম্পর্কে পুলিশ জানায়,-বিমানের হ্যাঙ্গারে কর্মরত এক শ্রেণীর মেকানিক ও ক্লিনার ফ্লাইটের ভেতরে যাতায়াতে সুযোগ পায়। তারা যে কোন অজুহাতে ফ্লাইটে প্রবেশের দরুন টয়লেটের ভেতর থেকে সোনা সরানোর সুযোগ পায়। তাদের সঙ্গে রয়েছে কেবিন ক্রু। ওদিকে আছে সিভিল এ্যাভিয়েশনের সিন্ডিকেট। ঘুরেফিরে এই একটি সিন্ডিকেটই বার বার চোরাচালানে জড়িত হচ্ছে। তাদের বেশিরভাগই শনাক্ত হয়ে গেছে। এবার ধরার পালা। তাদের শুল্ক গোয়েন্দা চিহ্নিত করেছে। অলআউট এ্যাকশানে এনবিআর ॥ চোরাচালানের ভয়াবহতা রুখতে এবার অল আউট এ্যাকশান গ্রহণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নজিবুর রহমান যোগদানের পর পরই তিনি এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যক্রম আরও জোরদার করার তাগিদ দেন। এ লক্ষ্যে প্রথমেই তিনি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোথায় ত্রুটি ও ফাঁকফোকর আছে সেগুলো চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন। এরপর বিমানের নতুন এমডিকে রাজস্ব বোর্ডে তলব করে চোরাচালান দমনে কার্যকর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। জানতে চাইলে নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন-ইতোমধ্যে সিভিল এ্যাভিয়েশন,বিমান ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দাকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করা হয়েছে। ভাল ভাল অফিসারকে শাহজালাল বিমানবন্দরে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। চোরাচালান নিয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
×